X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

আহ আমার বাংলাদেশ!

কাকলী প্রধান
১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:০৬আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:২৮

কাকলী প্রধান কয়েকদিন আগে বেশ কিছু বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাতে পরিচয়। পরিচয় থেকে দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা। পূর্বাচলে নতুন ঢাকা গড়ে উঠছে। সেখানেই কাজ করছিলাম। বিদেশি পর্যটকদের একজন জানতে চাইলেন, আমি ঢাকার বাসিন্দা কিনা। ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিতেই আবার প্রশ্ন–ঢাকা কি তোমার পছন্দের শহর? এবারও ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিলাম। তাতে ওরা বিস্মিত। কেন? কেন নয়! এই যে একটা শহর। কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে। এই ঢাকা শহর কত লাখ মানুষের কাজের জোগান দেয় জানা আছে! কত বিচিত্র মানুষ! কত তাদের জানা-অজানা গল্প ও কত হাজার রহস্য। পর্যটকদের ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। ছোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। ঢাকায় এত যানজট, হর্ন, বিচিত্র শব্দ, ময়লা, আবর্জনা, ভাঙা রাস্তা, মানুষ কিলবিল করছে, তবু? ‘হ্যাঁ’ তবু! যখন এইসব ঝক্কির মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়ে ক্লান্ত হই, তখন হয়তো বা এক টুকরো শান্তির খোঁজে চলে যাই শহর ছেড়ে দূরে। আবারও ফিরে আসি, ফিরে আসি বার বার। এই সব মানুষেরই ভিড়ে। ফিরতে ফিরতে মনে হয়, কতদিন পর আবার দেখবো রাস্তার মেয়ে ময়নাকে? রাস্তার ছেলে আকাশ, কিংবা বুড়ো চাচা আবদুল করিমকে, অথবা হাত নেই যে রুবেল নামের ছেলেটা। ওরা সবাই কাজ করে অন্ন জোগায়। কেউ রঙিন বেলুনে স্বপ্ন ওড়ায়, কেউ ফুল বেচে, কেউবা পাটের সামগ্রী ফেরি করে। এই তো আমাদের ঢাকা। ওরা হাসে। ওরা জানতে চায়, আমি কি মনে করি নতুন ঢাকা খানিকটা পরিকল্পিত হবে, নাকি সেই আগের মতোই? ওরা জানতে চায়, আমাদের সমস্যাটা কোথায়, পরিকল্পনায়? নিয়মে, নাকি প্রয়োগে? বিষয়টা কি পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণে এমন হচ্ছে? একটা ভালো, টেকসই পদ্ধতি দাঁড় করানো কি এতটাই অসম্ভব?
ওরা বললো–পূর্বাচল যদি নতুন ঢাকা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এখানে যানজট থাকবে না। এই নতুন ঢাকা নিশ্চয়ই অনেক পরিকল্পিত হবে? ঢাকার যানজটে বসে যে কারোরই অসুস্থ বোধ করার কথা। তাই না? অস্বীকার করার উপায় নেই। তবু আমতা আমতা করে বললাম, দেখো বাংলাদেশ গরিব একটি রাষ্ট্র। এখানে বসতি নির্মাণ শুরু হলেই আবার নতুন করে রাস্তা খোঁড়া খুঁড়ি শুরু হবে। স্যুয়ারেজ লাইন, ড্রেনেজ লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, টিঅ্যান্ডটি লাইন আরও কত কী! নতুন করে আবার ঢালো। বিদেশিদের প্রশ্ন ছিল, আমাদের মতো একটি গরিব রাষ্ট্রের এই বাতুলতা কি মানায়? যাদের বিদেশি পর্যটকদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ওরা বলছিল, তোমাদের প্রতিটি নাগরিকের ওপর বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা আছে। এই দায় আমরা মাথা পেতে নেবো কেন? এ কাজগুলো একবারে করা সম্ভব হলেও বিভিন্ন রকম দেওয়া-নেওয়া, ধান্দাবাজি, টেন্ডারবাজি জটজালে করা হয় না। পর্যটকরা আগ্রহের সঙ্গে এবং কিছুটা মুগ্ধ চোখে নিজেরা বলাবলি করছে পূর্বাচলের প্রকৃতি লাল মাটি সবটাজুড়েই এমন যে এটা একটা আকর্ষণীয় নতুন শহর হতে পারতো। যেখানে বহুতল ইমারত তৈরি হবে না। অনেকটা খামার বাড়ির আদলে শহর গড়ে তোলা যেত। তোমরা দেশটাকে খুব বেশি ঢাকামুখী করে তুলেছো। বিষয়টাই এমন যে ঢাকা এলেই সবার অর্থনীতি মুক্তি ঘটবে।
হঠাৎ একজন জানতে চাইলো, বাংলাদেশে মৌলবাদ চাঙ্গা হয়ে ওঠার কারণ কী? ভাষা নেই। মনে হলো ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। যতটা রেখে-ঢেকে উত্তর দেওয়া যায়, খানিকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’মার্কা ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম। বললাম, এটা আদতেই বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। এই সমস্যা বাংলাদেশের তৈরিও নয়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে নির্মূল করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকার তৈরি সমস্যা। যা এখন বুমেরাং হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, সেটা এটা এখন সব ‘তন্ত্র’-এর জন্যই হুমকি হয়ে গেছে। ভুক্তভোগী আমরা। এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সমস্যা। আমাদের ভুল রাজনৈতিক চর্চা। রাষ্ট্র ও সমাজের নানান ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়েছে জঙ্গিবাদ। মৌলবাদের মতো ভয়ঙ্কর ইস্যু। যাকে প্রথমেই রোধ করা যেতো সহজে। রাজনৈতিক বড় সব দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে চাওয়ায় মৌলবাদের মতো কঠিন বিষয়কে নিজ নিজ রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে ফেললো। যার খেসারত দিতে হচ্ছে চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ওরা আমাকে বলে–বড় বড় বাস ট্রাক একটানা হর্ন বাজিয়ে রাসেল স্কয়ার থেকে বসুন্ধরা শপিং মলের দিকে ছুটছে, পথের দুধারেই তো হাসপাতাল, বাসা-বাড়ি আছে। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা তোমরা কিভাবে মেনে নাও? লজ্জা পেয়ে মনে মনেই বলি–আমরা মেনে নেই না। আমরা আমাদের অন্যায় আচরণ অন্যকে মুখ বুঁজে মেনে নিতে বাধ্য করি।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায় বিদায় বেলায় ওদের একজন হাসতে হাসতে বললো–জানো, যখন আমার মাকে বাংলাদেশে আসার কথা জানালাম। মা তো আঁতকে উঠে কান্নাকাটি হুলস্থুল। কারণ, এখানে রানা প্লাজার মতো ভবন ধসে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এখানে ব্লগার হত্যা হয়। হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলা হয়েছে। ওদের শেষ প্রশ্ন ছিল-এত সব সমস্যার মধ্যেও আমি কেন বিদেশে স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করছি না? বললাম, আমি আমার মাটিতেই বিলীন হতে চাই। আমি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছি।
পাঠক এতক্ষণ পুরনো কথার জাবর কাটলাম। এত প্রসঙ্গের কারণ–সত্যিই যে বাংলাদেশের ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে, তার লজ্জা আমাদের বহন করতে হয়। এর ভার এতটাই ওজন যুক্ত যে বিনা বাক্যে বহন করাও নাগরিক হিসেবে অপমানজনক। বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর থেকে ধোঁয়াটে আবরণ তৈরি করা হয়েছে। অযথাই গর্বের ঢেঁকুর তুলি। অযথাই একে অপরকে দোষারোপ করে সন্তুষ্ট বোধ করছি। আমাদের প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে সরব, যারা দেশ জাতির মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন, তারাও দল ও নিজ স্বার্থের বাইরে নিজেদের দাঁড় করানোর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারেননি। রাজনীতির এই কুচক্র থেকে বেরুতে না পারলে কিভাবে একটি নতুন দিনের গান তৈরি হওয়া সম্ভব?

লেখক: সিনিয়র ফটোসাংবাদিক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে বললেন জেলেনস্কি
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে বললেন জেলেনস্কি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
সর্বশেষসর্বাধিক