X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালির রোম

আনিসুর রহমান
০৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৬আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:১৩

আনিসুর রহমান ইতালির সঙ্গে আমার প্রথম সখ্য বিদ্যালয়ের ভূগোল বইয়ের মাধ্যমে। আগ্নেয়গিরি বিষয়ে পড়তে পড়তে ইতালির ভিসুভিয়াসের কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল। ইতালির প্রসঙ্গ এলেই মনের গহিনে উঁকি দেয় ভিসুভিয়াসের নাম।

রোম শব্দটির সঙ্গে বনিবনা আরও একটু পরে। বিদ্যালয়ের বাংলা দ্বিতীয়পত্রে ও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে মাঝে মাঝে ভাষান্তর করতে হতো; বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা। সে সুবাদে আমি একটা বাক্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। বাক্যটি ছিল এ রকম– Rome was not built in a day. তখন মনের ভেতর একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়ে উঠেছিল ছিল– রোম কেন? কোনও শহর এমনকি আমাদের ঢাকা শহরও কি একদিনে গড়ে উঠেছে? যদিও তখন বুঝে গিয়েছিলাম, এই বাক্য দিয়ে রোম শহরের সৌন্দর্যের ব্যাপকতা বোঝানো হয়েছে। আরও পরে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আমি পৃথিবীর পথে অগ্রসর হতে থাকি, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে আমার আগ্রহে থাকা দুই মহাদেশের দুই প্রজন্মের দুই লেখকের সঙ্গে রোমের নাম জড়িয়ে আছে। তাদের একজন হলেন নরওয়ের নাট্যকার, কবি, সাংবাদিক ও চিত্রশিল্পী হেনরিক ইবসেন, আরেকজন হলেন বাঙালি কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ইবসেন নরওয়ের জাতীয় লেখক তহবিল থেকে বৃত্তি পেয়ে ১৮৭১ সালে রোমে পাড়ি জমান। তিনি ১৮৭১-১৮৯১ দুই দশকের মতো রোমে নির্বাসিত সময় পার করেন। ওই সময়ে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকর্ষণীয় কেন্দ্র ছিল রোম। গোটা ইউরোপের লেখক শিল্পীরা ইতালিতে ভিড় করতেন। ইবসেনও তার ব্যতিক্রম নন। ইবসেন পড়তে গিয়ে জেনে গেলাম তিনি নরওয়ের লেখক হলেও তার জীবনের বড় অংশ কেটেছে ইতালিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও ইতালি বা রোমের নাম জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ইতালি সফর করেন ১৯২৫ ও ১৯২৬ সালে। ইতালির একনায়ক মুসোলিনির আমন্ত্রণে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে ততদিনে জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেছেন। সারা দুনিয়া ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে তার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এজন্য ডলার কামানো বক্তা হিসেবে খেতাব বা অপবাদ জুটে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর নিয়ে হইচই বেধে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদ মুসোলিনির আতিথেয়তা কেন গ্রহণ করলেন, তা নিয়ে চারদিকে ছি ছি রব উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ পরে মুসোলিনিকে চিঠি লিখে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন।

ইতালির, বিশেষ করে রোমের আরেক তাৎপর্য হলো ভ্যাটিকান সিটির অবস্থান। এক দেশের ভেতরে আরেক দেশ নয় কেবল, খোদ রাজধানীর পেটের ভেতরে আরেক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ভ্যাটিকান সিটি। খ্রিস্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে খ্রিস্টধর্মের পোপের দফতর ও আবাসন। সেই ভ্যাটিকান সিটি ঘুরে ঘুরে ভেতরে যা পেলাম, পুরনো রাজপ্রাসাদ বা দুর্গের কথাই মনে পড়ে, আলো-আঁধারির কারসাজি, বিশাল দুর্ভেদ্য ইমারত, পুরনো অস্ত্রের প্রদর্শন।  আহা কে বলে গেছে বীরভোগ্য বসুন্ধরা! রোমের অন্যান্য আকর্ষণের মাঝে কলোসিউম অন্যতম। এটা দেখে এথেন্সের পার্থোনিউমের ছবিই স্মৃতিতে ভেসে উঠলো– ওই ঘুরেফিরে লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। যুদ্ধ আর শক্তি প্রদর্শনই ইতিহাসের নিদর্শনের একটা বড় জায়গা।

তারপর সেই ঝরনা। এখানে মনে মনে ঠিক করে ঝরনা পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে ঝরনায় পয়সা ছুড়ে ফেলা হয়। তাতে নাকি ইচ্ছে পূরণ হয়। আমার মনে একটা প্রশ্ন খেলে গেলো– আমাদের দেশে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো যেসব নেতা হাঁকডাক করতেছেন, তারা কি ওই ঝরনায় পয়সা ছুড়ে এসেছেন?

রোম শহরের অপার সৌন্দর্য দেখে আমার শৈশবের সেই মনকে প্রবোধ দিতে পারলাম– ‘সত্যিই রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি। এ জন্য শতকের পর শতক মানুষের প্রাণান্তকর চেষ্টা-নিষ্ঠা-রুচিবোধের প্রকাশ বাঞ্ছনীয়। এরই সঙ্গে বহুল শোনা একটা কথা মনে পড়ে গেলো। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেদিন রোমের বাণিজ্যিক এলাকা পুড়তে থাকে। এই আগুন ছয় থেকে সাত দিন চলে। রোম নগরীর বেশিরভাগ অংশই পুড়ে যায়। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, গুজব ছড়িয়েছিল সম্রাট নিরো রোম শহরে অত্যাচারের নির্দেশ দেন। সে কারণে সারা রোম জ্বলে ওঠে।  

আচ্ছা, আমাদের এই সময়ে নিরোর কি অভাব আছে? একবার পুরনো ঢাকায় আগুন লেগেছে। বছর কয়েক আগের ঘটনা। সেই সময়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে হাসতে হাসতে কথা বলেছেন। গোটা রোম শহরটা রুচি ও সভ্যতার প্রকাশ হৃদয়ের ছোঁয়া দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে, সাজানো হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, ‘নতুন কোনও স্থাপনা বা নিদর্শন নির্মাণ করতে গিয়ে পুরনো কোনও স্থাপনা নিদর্শনকে বিন্দুমাত্র অবহেলা, অবজ্ঞা বা ক্ষতি বা হানি করা হয়নি। সাইনবোর্ডের বাড়াবাড়ির প্রশ্নই নেই।

ইতালির খাবারের কথা বলতেই হয়। ইতালির খাবার কী? পিৎজা, পাস্তা আর আইসক্রিম। এর বেশি আমার জানা নেই, আগ্রহও নেই সে স্বাদ পরখ না করলে কী হয়। ইতালির পিৎজা, পাস্তা আর আইসক্রিম সত্যিই উপাদেয়। তবে কথা হলো,  যে ক’দিন রোমে ছিলাম, দুই একবার পিৎজা-পাস্তা পাতে নিলেও বাকিটা সময় বাঙালি রেস্তোরাঁয় বাঙালি খাবারই খেয়েছি।

রোমের নিদর্শন আর সভ্যতা ছাপিয়ে যে বিষয়টা দেখে আমি বেশি মুগ্ধ হলাম, তা বাঙালির উপস্থিতি। এখানে প্রতিটি অলিতে-গলিতে বাঙালির পদচারণা। হয় কোথাও দোকান, নয়তো ফুটপাতে ব্যবসার পসার, নয়তো বাসের টিকিট কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা; নয়তো বাসের টিকিট নিয়ন্ত্রক। অথবা বড় কোনও ব্যবসায়ী। নিদেনপক্ষে কোনও দোকানের কর্মচারী। রোদ-বৃষ্টি-রাতদিন বাঙালির বিরামহীন পরিশ্রম। কেউ বসে নেই, বাঙালির কষ্ট-শ্রম টিকে থাকার সংগ্রাম ও সাফল্য। রোম ঘিরে আমার মনে যে চিত্র আঁকা ছিল, সব ছাপিয়ে উঠেছিল। এই রোমে বাংলাদেশের সব পাওয়া যায়। কে বলবে রোম বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে। রোমের ভেতরে যেমন এক চিলতে এক ভ্যাটিকান সিটি, তেমনি আছে বড় এক বাংলাদেশ। বাঙালি এখানে হাত পাতে না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টিকে থাকার জন্যে লড়াই করে। বাঁচে-মরে সংগ্রামে, টিকতে পারে। এই রোমে পেয়ে যাবেন টাঙ্গাইলের চমচম, পদ্মার ইলিশ কিংবা পুরান ঢাকার বাকরখানি। অবাক হওয়ার মতো  কিছু নয়। সবই সম্ভব। পোপ আর নিরোই রোমই শেষ কথা নয়। রোম এখন বাঙালিরও, এই রোমে বাড়তে থাকা বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের বা বাংলাদেশের সংস্কৃতির দায়ভার যে মিশনের ওপর, সেই বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। জানতে খুব ইচ্ছে করলো  আমাদের দূতাবাস ওখানে বাঙালির এ রকম সাফল্যে কী ভূমিকা রাখে বা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে কী করে? দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখি, ভিসা পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ ছাড়া তাদের আর কোনও কার্যক্রমই নেই। রোমের মতো একটি শহরে আমাদের দূতাবাসের কাজ কি এটুকুই?

আহ! রাঙালির রোমেও দূতাবাসের এ রকম হাল? আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার দ্বার খোলার ব্যাপার দূতাবাসের কি কোনও গরজ নাই?

লেখক: কবি ও নাট্যকার, আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন

 

 

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ