আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এবার নিবন্ধিত দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। কাউন্সিলর পদে অবশ্য দলীয় প্রতীক থাকবে না। দলীয় ভিত্তিতে অনেক দেশে স্থানীয় নির্বাচনের প্রথা থাকলেও এতদিন বাংলাদেশে ছিল না। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনেকে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন। অনেকে বলেছেন, এটা নাকি বাকশাল কায়েমের ষড়যন্ত্র।
বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বাকশাল উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। তাই বাকশাল কালা না বোবা তা বোঝার কোনও সুযোগ দেশের মানুষের হয়নি। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর একটা উপ-নির্বাচন দেখেছিলাম কিশোরগঞ্জে। কোনও দলীয় নমিনেশন নেই, যার ইচ্ছা সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কিশোরগঞ্জে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দুজন। একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাই। অন্যজন স্কুলশিক্ষক। নির্বাচনে কারও পক্ষে শেখ সাহেবও যাননি, সৈয়দ নজরুল ইসলামও যাননি। তারাই প্রচারক, তারাই প্রতিদ্বন্দ্বী। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো মাস্টার সাহেব সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাইকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিতেছিলেন।
বর্তমান পদ্ধতিতে কোনও মাস্টারের পক্ষে নির্বাচন করার সাহস করাই সম্ভব নয়। কারণ দলীয় নমিনেশন পেতেই তো কয়েক লাখ টাকা খরচ করতে হয়, আর নির্বাচনে খরচ করতে লাগে ন্যূনতম ৪০ লাখ টাকা। বর্তমান পদ্ধতিতে গরিব রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাকশালের যে উপ-নির্বাচনটা দেখেছি, তাতে দুর্নীতিও দেখিনি, অঢেল অর্থের অপচয়ও দেখিনি। থাক। অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান নহে। অন্ধরাই বাকশাল কায়েমের ষড়যন্ত্র দেখছেন।
দেশের মানুষ খুশি হয়েছে এই দেখে যে, সব দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বিএনপি ১৫ দিন সময় বাড়ানোর কথা বলেছিল, আর জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ এমপিদের প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দাবি করেছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনও দাবিই গ্রাহ্য করেনি। সব দলই তাদের প্রার্থী বাছাই চূড়ান্ত করেছে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে। তবে, নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অটল থাকে কি না বলা মুশকিল। কারণ, বিএনপির সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক-মোক্তার হচ্ছেন খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া। তাদের ধারণা ক্ষমতা আরম্ভ হয় জাতীয় পর্যায়ে থেকে। তৃণমূল পর্যায়ে থেকেও যে ক্ষমতা ধীরে-ধীরে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছতে পারে সে ধারণায় সম্ভবত তারা বিশ্বাসী নন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দিয়েছিল অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে। নির্বাচনের আগেই বিদায় নিয়েছিলেন।
এবার চট্টগ্রাম ও ঢাকাতেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা ঠুনকো বিষয়ে অজুহাত তুলে ভোটের দিন বেলা ১২টার সময় ঘোষণা দিয়ে চলে যায়। তাও ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত। প্রার্থীরা লাখ-লাখ টাকা খরচ করলেন কিন্তু চূড়ান্ত ফল দেখতে পারলেন না। দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনের সময়ই নির্বাচন বর্জন করতে হলো।
বিএনপির বিদেশ নির্ভরতা বেশি। এটা রাজনৈতিক দারিদ্র্যের লক্ষণ। দেশের লোককেই চূড়ান্তভাবে অবলম্বন করে চলতে হবে। বিদেশ নির্ভরতা কোনও ভাল ফল দেবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিদেশিদের পরামর্শে বিএনপি বর্জন করেছিল। ফলতো ভালো হলো না। এটা ছিল খালেদা জিয়ার সর্বনাশা ভুল। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করার জন্য মানইজ্জত ত্যাগ করে তদ্বির করাও ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি থাকার পরও দেখা না করা আরও বড় ভুল। হরিণী শিকারি না চিনলে তো গুলিবিদ্ধ হবেই। এখন খালেদা জিয়ার অবস্থা হয়েছে তাই। হার হোক, জিত হোক—নির্বাচনে থাকাটাই হবে খালেদা জিয়ার জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত। সংগঠনটা যে এখন borrowed time-এর ওপর টিকে আছে, তা থেকে উত্তরণের বিকল্প অন্য কোনও পথ নেই।
জাতীয় পাটিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এরশাদের জাতীয় পার্টিরও জনসমর্থন ছিল কিন্তু এরশাদের কারণেই পার্টিটা বিনষ্ট হয়েছে। লোকটার ভুলে ভুলে পার্টিটার ইমেজ নষ্ট হয়েছে। দফায়-দফায় ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যাওয়া তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। অথচ আজ শতাধিক এমপি নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলেও তার ইমেজ থাকতো অনেক ঊর্ধ্বে। এখন জাতীয় পার্টির যেসব এমপি রয়েছেন, তাদের থেকেও অনেক যোগ্য দলীয় প্রার্থী এরশাদের উল্টা-পাল্টা সিদ্ধান্তের কারণে চলতি সংসদে প্রবেশ করার সুযোগ পাননি। সর্বোপরি ২০১৪ সালের নির্বাচনটাও এত প্রশ্নবিদ্ধ হতো না।
এরশাদ সম্ভবত মনে করেছিলেন, বিএনপি সরকার ফেলে দেবে। প্রশাসন যে সরকারকে এত দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেবে, তা হয়তো তিনি চিন্তা করেননি। প্রশাসনের দৃঢ় সমর্থন থাকলে গণ-আন্দোলনে সরকার ফেলানো সম্ভব হয় না। সর্বোপরি ২০১৪ সালের শেষ চার মাস বিএনপি জোট যে আন্দোলন করেছিল, তাতে জনগণের কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না। তা ছিল দলীয় ক্যাডারের অস্ত্রবাজি। তাতে দেশের আপামর মানুষ বিরক্ত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দল। তাদের প্রতিটি পৌরসভায় এতবেশি প্রার্থী, যে প্রার্থী সিলেকশনটা তাদের পক্ষে ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। প্রার্থিতা নিয়ে কলহের সীমা নেই। দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্ষমতায়। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার সম্মুখীনও হতে হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের কারণে আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ বিরক্ত। আওয়ামী লীগ নেত্রী দলের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দুস্থ, পতিত, নির্যাতিতদের জন্য তার অপরিসীম সমবেদনার গুণে তিনি এ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার প্রচলন করে তিনি সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অশেষ কল্যাণ করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি একমাত্র শাসক, যিনি প্রান্তিক মানুষের অভাব অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তার সময়েই দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়েও তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনের নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে চায়, তবে সবাইকে সংযমী হতে হবে। মানুষ চায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরের কাছে আসুক। ‘ইন্টারপ্রেটার’ নাটকের দর্শন-এর লাঠির মতো তা যেন কোনও অন্ধের হাতে গিয়ে না পড়ে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক