X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ করোনা

রুমিন ফারহানা
২৭ মার্চ ২০২০, ১৮:১২আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২০, ১৮:৫৬

রুমিন ফারহানা কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সকাল-বিকাল আমরা শুনেছি ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসছে বাংলাদেশ; সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে  বাংলাদেশ এখন লসএঞ্জেলেস, ভেনিস, প্যারিস, কানাডার পথে পা বাড়িয়েছে।  বড় বড় মোড়ল রাষ্ট্র নাকি চুপি চুপি কানে কানে বাংলাদেশের উন্নয়নের গোপন রহস্য জানতে চায়।  উন্নয়নের এই ‘বটিকা’ দেশের মানুষকে গেলানোর চেষ্টা চলছে ২০১৪ সাল থেকেই।  এয়ারপোর্টের সামনে ২/৩টি ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল স্থাপনের নামে পুরো ঢাকা শহরকে নরকে পরিণত করা,  হচ্ছে হচ্ছে করে গত ১১ বছর যাবৎ দফায় দফায় বাজেট বাড়িয়ে আজও পদ্মা সেতু শেষ না হওয়া,  বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অথচ নিম্নমানের,  ক্ষেত্রবিশেষে ভুল নকশায় সড়ক, রেল, উড়াল সেতু তৈরি করার মতো কিছু ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া আর কোনও উন্নয়ন এই সরকার করতে পেরেছে কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
হ্যাঁ, আরেকটি দিকে উন্নয়ন যে কেবল দৃশ্যমান তা-ই নয়,  বরং বিশ্বের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্বারাও স্বীকৃত।  ওয়েলথ এক্স-এর মতে, বিশ্বে অতি ধনী (যাদের সম্পদের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার ওপরে) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম,  ধনী (যাদের সম্পদের পরিমাণ ৮.৫ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকা) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়।  অথচ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম।  এই অভূতপূর্ব বৈষম্যই ব্যাখ্যা দেয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির,  ব্যাখ্যা দেয় সরকারের দাবিকৃত ‘উন্নয়ন’-এর।  উন্নয়নের এই ধারণা আইয়ুব খান থেকে এরশাদ সব স্বৈরশাসকই রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে গেছেন।

সরকার যখন উন্নয়নের এই প্রপাগান্ডায় ব্যস্ত ছিল এবং সরকারের কিছু সুবিধাভোগী তা গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রচার করে গেছে,  তখন সচেতন নাগরিক হিসেবে বারবার আমরা বলেছি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, আইনের শাসন,  সোশ্যাল সেইফটি নেট-সহ আরও কিছু বিষয়ের কথা, যা গণমানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা খুব স্পষ্ট হলো যখন মহামারি আকারে নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বময়।

করোনার কথা চীন অফিসিয়ালি ঘোষণা করে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। আর বাংলাদেশে এর সরকারি স্বীকৃতি মেলে ৮ মার্চ ২০২০। সুতরাং সরকারি হিসাব মতেই সরকার সময় পেয়েছিল ২ মাস ৮ দিন। অথচ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা সরকার  এই সময়ে এর সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তা ভাবলে অবাক না,  আতঙ্কিত হতে হয়।  দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কেবল একটিতে দু’টি থার্মাল স্ক্যানার ছিল,  যার একটি আবার অল্প দিন পরেই বিকল হয়ে যায়,  আর স্থলবন্দর সবগুলোই ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।  

গণমাধ্যমে পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে,  যা নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ কঠিন হবে।  জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে এসেছে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এসেছে করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। অথচ কোয়ারেন্টিনে আছে মাত্র ১৮ হাজারের কাছাকাছি মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাবিহীন উন্নতির প্রপাগান্ডা চালানো সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বাকি ৬ লাখ ৩০ মানুষের হদিস জানতে এবং ব্যবস্থা নিতে। তারা বাজারে গেছেন,  জমায়েত হয়েছেন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা করেছেন,  মসজিদে গেছেন,  করেছেন আরও অনেক কিছু, যার দ্বারা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে।   

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা,  তা হলো– পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সব দেশেরই উচিত সন্দেহজনক সব রোগীকে পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে থাকলে দেশগুলো এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না’।  তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা যাবে না,  সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না’।  যেখানে সন্দেহভাজন রোগীকে শনাক্ত করতেও পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,  সেখানে দেখা গেলো উন্নয়নের মহাসড়কে উসাইন বোল্ট-এর গতিতে ছুটে চলা বাংলাদেশে কিছুদিন আগ পর্যন্ত কিট ছিল মাত্র ১৭৩২টি এবং দেশে পরীক্ষার একমাত্র ভরসা ছিল আইইডিসিআর। মিরপুরের টোলারবাগে বসবাসকারী অফিসিয়ালি করোনায় মৃত্যুবরণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তির ছেলে জানিয়েছেন, কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর তিনি যখন আইইডিসিআর কর্মীদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন,  তখন তাকে জানানো হয় যেহেতু তাদের বাসায় কোনও প্রবাসী যায়নি তাই তারা তার বাবার পরীক্ষা করবে না।

‘উন্নয়ন উন্নয়ন উন্নয়ন’ এই স্লোগানের মাঝখানেই হঠাৎ করে শুনতে পেলাম করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে এমন রোগীকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অথচ পিপিই হলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থেকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত পোশাক নীতিমালা। একই দিনে আইইডিসিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল তখন পর্যন্ত পিপিই পাওয়া গেছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার। যেহেতু একটা পিপিই একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না,  তাই কোথাও কোথাও এক পিপিই ভাগ করে পরতে বলা হয়েছে।

এবার একটা হিসাব করা যাক। বর্তমানে দেশে ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এর সঙ্গে নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া এবং ক্লিনার-সহ সংখ্যাটা কয়েক লাখ। যখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয় তখন হাসপাতালে কাজ করা প্রতিটি মানুষের পিপিই পরে কাজ করা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সরকারের হাতে মজুত পিপিই দিয়ে চলবে একদিন।  

করোনায় সংক্রমিত সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসায় কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র বা ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু করোনার চিকিৎসায় এই সুবিধা আছে শুধু ঢাকাতে, বাকি ৬৩ জেলায় কোনও ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র মতে, করোনা মোকাবিলায় সারা দেশে ৪৫১৫টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত করা হয়েছে,  এরমধ্যে শুধু ঢাকাতেই করা হয়েছে ১০৫০টি।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ প্রসঙ্গে দৈনিক বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ রোগীকে আইসিইউ-তে রাখতে হতে পারে এবং এসব রোগীকে শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে প্রয়োজন ভেন্টিলেটর।  বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের দেহে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে।  এর মাত্র এক শতাংশ যদি রোগাক্রান্ত হয়,  তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ১ লাখ ৬০ হাজার। এর ১০ শতাংশেরও যদি আইসিইউ প্রয়োজন হয়,  তাহলে আইসিইউ প্রয়োজন ১৬০০০। দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড আছে ২২১টি,  যায় অনেকগুলোতেই ভেন্টিলেটর নেই। উন্নয়নের মহাসড়কে প্রচণ্ড বেগে ধাবমান এক রাষ্ট্রের নাগরিকরা কেমন বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে যাচ্ছে,  স্পষ্ট হয়েছে তো আমাদের কাছে?

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মাত্র জিডিপি’র এক শতাংশেরও কম, যা ন্যূনতম ৫ শতাংশ হওয়া উচিত। স্বাভাবিক সময়ে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সে কারণেই সাধ্যাতীত ব্যয় হলেও মানুষ ছোটে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় ৬৬ লাখ মানুষ। অথচ স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। বারবার বলা সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে কখনোই মনযোগী হয়নি। কারণ, তাদের ছিল ব্যাংকক,  সিঙ্গাপুর,  লন্ডন কিংবা আমেরিকা।

তথাকথিত উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান বাংলাদেশের সামনে করোনা পড়া মাত্রই প্রমাণিত হয়ে গেলো, কী ঠুনকো এই দেশের উন্নয়ন! কী ভঙ্গুর এই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা! এই লেখা যখন লিখছিলাম তখন সরকারি ভাষ্যমতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৮। এতেই এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সব লেজেগোবরে করে ফেলেছে। লজ্জায় চুপ থেকে যখন অতি ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সরকারের,  তখন সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী গর্বিতভাবে ২৪ মার্চ এক ভিডিও বার্তায় জানান, ‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের কাছে মেডিক্যাল সরঞ্জাম চায় যুক্তরাষ্ট্র।’

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (১ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১ জুলাই, ২০২৫)
বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে
বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে
দুর্ঘটনায় ছয় মাসে প্রাণ হারিয়েছে ৪২২ শ্রমিক
দুর্ঘটনায় ছয় মাসে প্রাণ হারিয়েছে ৪২২ শ্রমিক
৪০ শতাংশ কৃষক পান না ন্যায্য মজুরি: জরিপ
৪০ শতাংশ কৃষক পান না ন্যায্য মজুরি: জরিপ
সর্বশেষসর্বাধিক