X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিকদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া যে কারণে

ড. উত্তম কুমার দাস
০১ মে ২০২০, ১২:৪৯আপডেট : ০১ মে ২০২০, ১৪:২৭

ড. উত্তম কুমার দাস টেলিভিশন খুললেই এ চিত্র। হৃদয়বিদারক। কারও মাথায় বোঝা, হাতে ব্যাগ, কারও কোলে শিশু সন্তান। প্রখর রোদে তাদের এ পথ চলা; যানবাহন নেই, তো কী হয়েছে—হেঁটেই চলা। এই চিত্র টাঙ্গাইল, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সর্বত্র। এরাই আমাদের গার্মেন্টশ্রমিক। রফতানি শিল্পের কর্ণধার। 
এহেন ঘটনার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা যায়, তা হলো—ছুটি নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণার অভাব, কার জন্য ছুটি, কীভাবে, করোনা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই বিষয়ক সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, কারখানা বন্ধ-খোলা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মালিক ও তাদের সংগঠনের সিদ্ধান্তহীনতা ও যথাসময়ে ঘোষণার অভাব, শ্রমিকদের মধ্যে ভুল তথ্য প্রচার ও বিদ্যমান অসহায়ত্ব—ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, বকেয়া মজুরি ও পাওনাদি পরিশোধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না থাকা প্রভৃতি। 
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে সরকার ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করে লোকজনকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়। সরকারের পক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিগত ২৪ মার্চ এতদসংক্রান্ত প্রথম প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর মাধ্যমে ২৭ মার্চ থেকে থেকে এই ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হয়; আরও তিন দফা বেড়ে যা এখন ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের কর্মপরিধি সংক্রান্ত যে বিধিমালা রয়েছে তার আলোকে এই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত আদেশে জরুরি সেবাখাত, রফতানিমুখী শিল্প, ওষুধ শিল্প প্রভৃতি ছুটির আওতামুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে।

তবে এই ব্যতিক্রমী কার্যক্রম (যারা আওতামুক্ত) কীভাবে চলবে, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর কোনও সম্পূরক আদেশ কিংবা বিস্তারিত নির্দেশনা জারি করেনি। ফলে বরাবর বিভ্রান্তি রয়েই গেছে।

অপরদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক গত ১৬ এপ্রিল এক আদেশে করোনার সংক্রমণ রোধে লোকজনকে ঘর থেকে বের না হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তার এই আদেশ সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর ১১(১) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে। এই আদেশ পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ এবং এর অন্যথা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাহলে প্রশ্ন এখন যা কিছু ঘটছে তা কীভাবে? কীভাবে কারখানা-দোকান খোলা হচ্ছে?

আশ্চর্যের বিষয় হলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৩ এপ্রিলের যে প্রজ্ঞাপন, তাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই আদেশের কোনও রেফারেন্স নেই। একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উল্লিখিত আদেশে আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আগের আদেশগুলোর কোনও রেফারেন্স নেই।

যে বিষয়টি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে তা হলো সরকারের ‘সাধারণ ছুটির’ (যা মূলত জেনারেল হলিডে) প্রজ্ঞাপন কীভাবে বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও কারখানার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সেই বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা বা নির্দেশনা নেই।

সংবিধানের বিধান (১৫২ অনুচ্ছেদ) অনুসারে, সরকারের নির্বাহী আদেশ এবং বিজ্ঞপ্তিও ‘আইন’ বলে গণ্য করতে হবে। এটি একটি সরল ধারণা।

একই সঙ্গে বলা যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও কারখানা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; উক্ত আইন সংসদ কর্তৃক পাসকৃত। তাই এর প্রাধান্য নির্বাহী আদেশের চেয়ে বেশি। আর শ্রম আইনের বিধান মতে সংশ্লিষ্ট মালিক বা নিয়োগকারী দুই ধরনের ছুটি নিজে নির্ধারণ করেন—একটি সাপ্তাহিক ছুটি (হলিডে) ও অন্যটি উৎসব ছুটি (হলিডে)। অন্য ছুটি (যা লিভ) হলো অর্জিত, নৈমিত্তিক কিংবা স্বাস্থ্য ছুটি (যেগুলো লিভ); সংশ্লিষ্ট শ্রমিক বা কর্মী তার চাকরির সুবাদে অর্জন করেন।

তাই সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ (জেনারেল হলিডে) শ্রম আইনে কীভাবে সন্নিবেশিত হবে তা এক আইনি প্রশ্ন। প্রশ্ন এই কারণে যে, সংশ্লিষ্ট মালিক (নিয়োগকারী) যে ছুটি (হলিডে) ঘোষণা করেননি সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য কোনও ছুটির (হলিডে) বা তার সময়ে প্রযোজ্য মজুরির দায় তার কি-না।

এখানে যুক্তি হলো, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে যে নির্বাহী আদেশ তা আইন বলে গণ্য হবে এবং শ্রম আইনের আওতাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-কারখানার জন্যও তা প্রযোজ্য হবে।

তবে এই বিষয়ে সরকারের ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণার প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রম আইনের আওতায় যেসকল প্রতিষ্ঠান-কারখানা, তাদের ক্ষেত্রে সেই ছুটি কীভাবে প্রযোজ্য হবে এবং সে সময়ে চাকরির শর্তাবলি বা শিল্প-সম্পর্ক কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেসব বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনও দফতরের সম্পূরক আদেশ ও নির্দেশনা জারি করা দরকার ছিল। তাহলে কোনও বিভ্রান্তি তৈরি হতো না।

এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন—ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের (২০০৫) আওতায় দেশব্যাপী ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান বলে এই আদেশ জারি করেছেন তাদের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব। একই সঙ্গে তাদের কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রণালয় মালিকদের নেতৃস্থানীয় সকল সংগঠন বরাবরে লিখিত পত্রে (তারিখ ২০ মার্চ) করোনার সময় মালিকদের সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে এই সময় কোনও শ্রমিককে ছাঁটাই বা টার্মিনেট না করতে অনুরোধ করেছেন এবং করোনাকালে (কোভিড-১৯) কর্মস্থলে শ্রমিক-কর্মচারীর অনুপস্থিতিকে কর্ম-সময় (অন ডিউটি) বলে বিবেচনা করার অনুরোধ করেছেন। বিপরীতে সরকার শিল্প-মালিকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে।

পাকিস্তান বিষয়টিকে মোকাবিলা করছে প্রদেশ পর্যায়ে। যেমন—সিন্ধু প্রদেশের ক্ষেত্রে সেখানকার স্বরাষ্ট্র বিভাগ ২৩ মার্চ জারি করা আদেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। তারা সেখানকার মহামারি রোগ সংক্রান্ত আইন (২০১৪) প্রয়োগ করেছে। একই আদেশে এই সময় কোনও শ্রমিককে যাতে লে-অফ কিংবা ছাঁটাই না করা হয় তাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সিন্ধু সরকার পরিষ্কার করে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের লকডাউনের সময় সকল শ্রমিককে পূর্ণ মজুরি দিতে হবে, আর তা দেবেন সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী বা শিল্প-মালিক। বন্ধকালীন সময়কে মজুরিসহ ছুটি বলে গণ্য করতে হবে। পাকিস্তান সরকারও সেখানকার শিল্প-মালিকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে।

এবার আমাদের দেশে ফেরা যাক। সরকার রফতানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যার জন্য শিল্প-মালিকদের কোনও সুদ দিতে হবে না। এই অর্থ যারা নেবেন তাদের ২% সার্ভিস চার্জসহ দুই বছর মেয়াদে গৃহীত অর্থ ফেরত দিতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলছেন, এই প্রণোদনা শ্রমিকদের কয়েক মাস মেয়াদে চাকরিতে টিকিয়ে রাখার জন্য, তাদের বেতনভাতা যাতে অব্যাহত থাকে।

তাহলে, বার্তা কিন্তু পরিষ্কার। কোনও কারখানায় কাজ থাকুক বা না থাকুক শ্রমিক তার চাকরিতে বহাল থাকবেন। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অনেক আগেই এই বিষয়ে শিল্প-মালিকদের পরিষ্কার লিখিত বার্তা দেওয়া দরকার ছিল। এই নির্দেশনা না দেওয়ার সুযোগে প্রায় হাজারখানেক গার্মেন্ট কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। (অনেকে এখন তা থেকে ফেরত আসছেন বলে শোনা যাচ্ছে)।

লে-অফ শ্রম আইনের আওতায় শিল্প-মালিকদের জন্য কারখানা সাময়িক মেয়াদে বন্ধ ঘোষণার একটি প্রক্রিয়া। এতে স্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি থাকে এবং এই সময় তাদের মূল মজুরির অর্ধেক এবং বাড়িভাড়া (ও প্রযোজ্য অন্যান্য ভাতা) দিতে হয়। তবে লে-অফের খারাপ দিক হলো—এর ফলে যেসব শ্রমিক অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) ও যাদের চাকরির বয়স এক বছরের কম লে-অফ কালে তারা কোনও মজুরি বা ক্ষতিপূরণ পায় না, পরে ছাঁটাই হলে তাদের চাকরির অবসান হয়। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে, গার্মেন্ট শিল্পের মোট ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ২০% থেকে ৩০% এর চাকরির বয়স এক বছরের কম। তাই দেখা যাচ্ছে, লে-অফ হলে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক শুধু পোশাকখাতেই চাকরি হারাবে, যার সামাজিক প্রভাব ভয়াবহ।

বিষয়টি বুঝতে পেরে দরিদ্র শ্রমিকদের রক্ষা ও আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পক্ষ থেকে করোনাকালে শিল্প-কারখানা লে-অফ ঘোষণা, শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই ও টার্মিনেশন বন্ধ করতে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর (যেমন—১২, ১৬, ২০ ও ২৬ ধারা) মালিক কর্তৃক-প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে (যা এক ধরনের অব্যাহতি) এক প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর হয়েছে। তবে প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। শ্রম আইনের ৩২৪ ধারায় সরকারের এই ক্ষমতা রয়েছে, যা প্রয়োগ করতে পারেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব। তবে তাতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ‘অনুমোদন’ দরকার হয়।

সর্বশেষ জানা গেছে, শিল্প-মালিক ও শ্রম প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকে আগামী ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিক ছাঁটাই বা লে-অফ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি এখনও একটি সুপারিশ মাত্র। একে প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশনায় পরিণত করতে হবে এবং ব্যাপক প্রচার করতে হবে। না হলে এ নিয়েও গুজব ও বিভ্রান্তি চলতেই থাকবে।        

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং মানবাধিকার ও শ্রম আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী।


ই-মেইল: [email protected]   



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ