X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহারে ঈদ!

শান্তনু চৌধুরী
৩১ জুলাই ২০২০, ১৩:৩৬আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২০, ১৫:০২

শান্তনু চৌধুরী উৎসব প্রিয় বাঙালি জাতির জন্য গেলো পাঁচটি মাস কেটেছে একেবারে উৎসবহীন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার পর দৃশ্যত আর কোনও উৎসবে মাততে পারেনি বাঙালি। তবে শুধু বাঙালি বা বাংলাদেশিদের কথাই বা বলি কেন। পৃথিবীর সব দেশে মুছে গেছে উৎসবের রঙ। করোনার প্রকোপ না কমলেও যেভাবে মানুষজন ‘থোড়াই কেয়ার’ করে করোনার সাথে বসতি করার মানসিকতা নিয়ে বাইরে বের হচ্ছেন, তাতে মনে করা হয়েছিল অন্তত ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদটা হয়তো জমে উঠবে। কিন্তু করোনার মতো এক ভয়ংকর ভাইরাস যে উৎসবেও বাগড়া দিয়ে বসে আছে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভ্যাকসিন আসার আগে অথবা এই বছরে আর কোনও উৎসবই ঠিকমতো জমবে না। হয়তো কোনও উৎসবই উদযাপন করা হবে না। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার্থে পালন করা হবে।
এমনিতে প্রকৃতিও চায় না চলতি বছরে কোনও উৎসব আয়োজন হোক! আবার যতই বলি স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই ভয়টা কাজ করছে। কারণ, এই সময়ে নিশ্চয় নিকটজন, প্রিয়জন, আত্মীয় বা পরিচিত জনের মৃত্যু কোনও না কোনও মানুষকে দেখতে হয়েছে। সে কারণে ঈদের বাকি না থাকলেও জমে ওঠেনি রাজধানীসহ অনেক এলাকার কোরবানির পশুর হাট। হাটগুলোতে নিরাপত্তার কথা ভেবে ওয়াচ টাওয়ার, সিসিটিভির ব্যবস্থা বা করোনার ভয়ে হাত ধোয়ার যতই ব্যবস্থা করা হোক না কেন, মানুষ কিন্তু নেই বললেই চলে। আবার যেটা সমস্যা হয়েছে নানা কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, বেতন কমেছে। এসব কারণে কোরবানিও ভাগাভাগি করে বা অন্য কোনও উপায়ে দিচ্ছেন।

এখন অনেক বেপারিই বলছেন, তার অনেক যত্নে লালন করা পশুটা যে দাম চাইছেন কেউই সেই দামে নিচ্ছেন না। পাঁচ লাখ বা দশ লাখ টাকা দামের গরুগুলোর যে দাম দিতে চাইছেন ক্রেতারা, সেটা নিলে বেপারির লালন পালন খরচ ও উঠবে না। আবার আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে এর মধ্যে। যেটা কয়েক বছর ধরে চলছে, কিন্তু করোনার  এই পরিস্থিতিতে মানুষ সেটাতেই অভ্যস্ত হয়েছে। অনলাইনে কেনাকাটা। দৈনন্দিন সদাই থেকে সবকিছুই এখন অনলাইননির্ভর হয়ে পড়ছে। কোরবানির পশু কেনাকাটার মধ্যেও সেটা বেশি করে ঢুকে গেছে। এখন অনলাইনেও চলছে পশু কেনাকাটা। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রচার করে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। যদিও কেউ কেউ খুৎবায় সমানে বলে যাচ্ছেন যতই করোনা আসুক হাটে গিয়ে গরু কেনার কথা!

এবার আসি শপিং প্রসঙ্গে। কোরবানির ঈদে এমনিতে শপিং যে খুব একটা হয় তা নয়। কিন্তু যেহেতু ঈদুর ফিতর আ রোজার ঈদে শপিং কমপ্লেক্সগুলো সেভাবে খোলা রাখা যায়নি, আবার ভয়ও ছিল বেশি, সে কারণে কেনাকাটা করেননি বেশিরভাগ লোকজন। আশা ছিল এবার হয়তো লোকজন মার্কেটে এসে কেনাকাটা করবেন। কিন্তু সেই আশাতেও গুঁড়েবালি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে বিশাল ফারাক। প্রস্তুতির কিন্তু কমতি ছিল না শোরুমগুলোর। বাহারি ডিজাইন আর নান্দনিক নকশায় সাজানো রয়েছে ছেলেদের পাঞ্জাবি, মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, ওয়ান পিস, টু পিস, শাড়ি আর বাচ্চাদের রকমারি পোশাক। কিন্তু খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মার্কেটে আসছেন না ক্রেতারা। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইন এবং অফারের দিকে নজর দিচ্ছেন বিক্রেতারা। কিন্তু কথা হলো কয়জনই বা অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত, চিরচেনা মার্কেটের ভিড় না থাকলে উৎসবটা ঠিক জমে না। আর করোনাকাল চায় না উৎসব জমে উঠুক।

ঈদে বাড়ি ফেরার তাড়াও নেই এবার। বাস, রেল বা লঞ্চ কাউন্টার কোথাও নেই টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড়। অন্য সময় যেখানে রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করতেন বাড়িমুখী লোকজন। সেখানে এখন সব কাউন্টার ফাঁকা। এখন পর্যন্ত হিসাব বলছে, মাত্র ৩০ শতাংশ দূর পাল্লার বাস চালু রেখে প্রতি ট্রিপে যাত্রী মিলছে ৭ থেকে ৮ জন। ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েও কাঙ্ক্ষিত বুকিং পাচ্ছে না এয়ারলাইন্সগুলো। এমনিতে করোনায় কাজ হারিয়ে অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছেন আগে। আবার ঈদ উপলক্ষে পাওয়া তিনদিনের সরকারি ছুটিতে কর্মস্থল ত্যাগে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ কারণেও ধাক্কা লেগেছে পরিবহন বাণিজ্যে। রেন্ট এ কারের ব্যবসায়ও আগেরে মতো বুকিং নেই। এবার লঞ্চের ক্ষেত্রে নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে বন্যার পানি। প্রতিটি নদীর পানি বাড়ায় লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ঢাকার আশপাশের সবগুলো নদীতে পানি বেড়েছে। পানির প্রবল স্রোতের কারণে সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়েছে পদ্মা সেতুর কাজও। লঞ্চযাত্রা আরামদায়ক হলেও লঞ্চ মালিক সমিতির দাবি, এবার যাত্রী সংকটে লোকসান গুনতে হবে কয়েকশ কোটি টাকা।

এবার উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এবং এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে ইতোমধ্যে সরকারিভারে জানানো হয়েছে। এর জন্য হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। কিন্তু দৃশ্যমান কোনও সহযোগিতা বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য চোখে পড়ছে না। আবার যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা ব্যক্তি মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতো, তারা মাত্র কিছুদিন আগে একদফা করোনাকালীন সহায়তা করেছেন, এখন আবার বন্যা!

লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গিয়ে, মাছের খামার থেকে শুরু করে চাষের ফসল, বীজতলা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। তাদের জীবনে ঈদ যে আনন্দ বয়ে আনবে না সেটাই স্বাভাবিক। এছাড়া অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য পশু লালন পালন করছিলেন, বন্যার কারণে তারা এসব পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। না পারছেন পশুগুলো বিক্রি করতে না পারছেন ঘরে ঠিকমতো রাখতে। মানুষ পশু একসাথে বাস করে এই নৈসর্গিক বিপদে সাম্যসাধন করছেন। ঈদ তো দূর অস্ত, জীবনের আনন্দও এদের কাছে নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে বড় বাঁধে বা উঁচু রাস্তায়।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রী প্রতিবারের মতো এবারও বলেছেন, ঈদযাত্রায় তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু অনেক মহাসড়ক ভালো থাকলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এখনও বেহাল দশা রয়েছে। এছাড়া বন্যা ও বৃষ্টিতে যেসব সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলোর যথাযথ মেরামত হয়নি। করোনার কারণেও সেটা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে বাড়িফেরা মানুষের সংখ্যা কম হলেও ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, চুরি, ছিনতাই রোধসহ মানুষের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মানুষের হাতে এখন টাকা নেই। সে কারণে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা আকছার ঘটছে। সব যে খবরের কাগজে আসছে বা থানায় অভিযোগ হিসেবে আসছে  তা নয়। বিষয়টি বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দাবি রাখে।

প্রকৃতপক্ষে উৎসব আনন্দের জন্য কোথাও কোনও সুখবর নেই। এই বছর বাঙালি আর উৎসবে মাততে পারবে বলে মনে হয় না। শুধু এই বছরই বলি কেন, নিজেদের যদি সচেতন না করি তবে আবার কবে প্রাণখুলে হাসতে পারবো সেটা বলা মুশকিল। কবে আবার মাস্ক খুলে মুক্ত বাতাসে ফুসফুস ভরা যাবে সেটি অজানা। তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সংক্রমণ কমিয়ে আনা গেলে, মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় চলে এলে আবার হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক হবে। এজন্য প্রয়োজন আমাদের প্রতিটি মানুষের সচেতনতা। সেটি ঘরে বাইরে সবখানে। তাহলেই হয়তো কেটে যাবে ঘোর অমানিশা। মিলতে পারবো যেকোনও প্রাণের উসবে। আবার হাত থাকবে হাতে, বুক মিলবে বুকের সাথে। সমস্বরে খুশিতে বলতে পারবো ঈদ মোবারক।  

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক    

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ