X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কতটা প্রতিবাদ হলে বিচার পাওয়া যায়?

লীনা পারভীন
০৫ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩৮আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩৯

লীনা পারভীন করোনা নামক এক অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় যখন গোটা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশের বুকজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষণের সংবাদ। করোনাকে ভয় দেখিয়ে মহাসমারোহে ধর্ষকের দল মাঠে নেমেছে তাদের ধর্ষকামী মনোষ্কামকে চরিতার্থ করতে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কয়টি সংবাদ আবার সবার নজর কেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখানো পুরুষরূপী কিছু হায়েনা নিজেদের 'বীরত্ব'কে জাহির করছে নারীদের ওপর।
ধর্ষণের ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ধর্ষকরা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে এই সমাজে। ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বাকপ্রতিবন্ধী নারী, ছোট শিশু। পাহাড়ে, সমতলে সমানতালে চলছে ধর্ষণের ঘটনা। পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণের মতো ঘটনাও দেখলাম আমরা। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সিলেট এমসি কলেজে দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একজন নারী। ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন পরিষদের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে কিছু বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও।


এই লেখা শেষ না হতেই আলোচনায় এসেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর পৈশাচিক উপায়ে নির্যাতনের এক ভিডিও। তাহলে প্রশ্ন আসে, কোথায় নিরাপদ নারী? চাঁদপুরের যে পিতা তার কন্যাকে ধর্ষণ করলো তার কোথায় সমস্যা ছিল? এই ধর্ষণের কারণ কী হতে পারে? জানা যায় সেই পিতা একজন মাদকাসক্ত। তার মানে ধর্ষণের পেছনে জৈবিক কোনও চাহিদা কাজ করে না। যারা ধর্ষণ করে তারা কোনও না কোনোভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ।
একটি অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গত আগস্ট মাসেই নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে মোট ২৪৯টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা আছে ৩২টি (বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী)।

ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার তুলনায় বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে কয়টি? সেই হিসাব তুলে ধরতে গেলে আমাদেরকে খুব কষ্ট করার দরকার হয় না। কারণ অপরাধের মাত্রার তুলনায় বিচারের মাত্রার অনুপাত এতই নগণ্য যে হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। সর্বশেষ কোনও ধর্ষণ মামলার বিচার কত দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিল সেটি মনে করতে গেলেও আমাদেরকে ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে হবে অনেকদিন।
এই যে বিচারহীনতা তার পেছনের আসল কারণ কী? এ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনায় আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার প্রায় বেশিরভাগই হয়েছে যখন মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব জায়গায়। বেগমগঞ্জের ঘটনার ৩২ দিন পরে এসে ফেসবুকের বরাত দিয়ে নড়েচড়ে বসেছে আমাদের পুলিশ প্রশাসন। গ্রেফতার করেছে দেলোয়ার বাহিনীর দেলোয়ারসহ কয়েকজনকে। প্রশ্ন আসে, এই ৩২ দিন তারা কেন কিছু করেনি? কেন স্থানীয় প্রশাসন এমন বরফ শীতল অবস্থানে থাকে? মানুষ জাগে কিন্তু জাগে না বিচারিক কাজের গতি। জাগে না আমাদের পুলিশের বিবেক। জানা যায় দায়ের করা মামলার শতকরা মাত্র ৩ - ৬ ভাগের বিচার হয় এদেশে। ধর্ষণের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই তার বেশিরভাগই হয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে। তার মানে এর বাইরে কী পরিমাণ মামলা থানায় দায়ের করা হয় তার সঠিক হিসাব জনগণের সামনে পরিষ্কার না। এছাড়া থানার পরিবেশ, মামলার ধীরগতি, বিচারের নামে হেনস্তা, সাক্ষীর অভাব ইত্যাদি কারণে আইনের প্রতি তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনাস্থা। আর এই অনাস্থা থেকেই অনেক নারী সাহস করে মামলা পর্যন্ত যায় না।
আইনের দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ঘুরে বেড়ায় প্রতাপের সঙ্গে। একটি ঘটনায় যখন বিচার আসে না তখন আরেকটি ঘটনার ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। অপরাধীরা ধরেই নেয় একজন নারীকে ধর্ষণ করলে তার কিছুই ক্ষতি হবে না বরং এলাকায় অনেকেই তাকে ভয় পাবে। বেড়ে যাবে তার প্রভাব। ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার এখনও কোনও সুরাহা হয়নি। ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলের রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ২০১৮ সালে চারজন আসামির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হলেও ২০২০ সালের শেষে এসেও এখনও সেটি উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে।
ধর্ষণের মতো ঘটনাকে “জিরো টলারেন্স” হিসাবে মেনে নিয়ে এর বিচার করতে হবে বিশেষ আদালতের মাধ্যমে যেখানে অন্য মামলার জটলায় ধর্ষণের মামলা চাপা পড়ে গিয়ে হারিয়ে যাবে না। ফেসবুক নির্ভর লোক দেখানো গ্রেফতার না করে লোক জানার আগেই নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ।

একটা কথা পরিষ্কার মানতে হবে যে ধর্ষণের প্রভাব কেবল একজন নারীর ওপর পড়ে তা নয়, এর একটি সুবিস্তৃত সামাজিক প্রভাব রয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি যখন খোলা ময়দানে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়ায় তখন তার ভেতরে অপরাধী ভাব আসে না বরং বিজয়ী ভাব আসে। তার দেখাদেখি অন্যরাও সমান অপরাধ করার সাহস পায়। সামাজিকভাবে নারীরা হয়ে যায় সবচেয়ে নাজুক। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীটির জন্য সুস্থভাবে সামাজিক পরিবেশে বেঁচে থাকা হয়ে যায় বিরাট চ্যালেঞ্জিং।

পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষই দায় এড়ানোর সুযোগ পায়। জবাবদিহিতা হয়ে যায় সোনার হরিণ। আস্থাহীনতার বীজ এভাবেই বাড়তে থাকে সমাজে। বিচারের প্রতি উদাসীনতা কমিয়ে দেয় অপরাধকে অপরাধ হিসাবে দেখার প্রবণতাকে।
সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের টার্গেটের সঙ্গে আইনের শাসনের নিশ্চয়তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তাহলে ক্ষমতায়ন বিষয়টি হয়ে যায় হাস্যকর। বেগমগঞ্জে যেসব পুরুষ নামক হিংস্র প্রাণী এমন জঘন্য ঘটনাকে আনন্দ উল্লাসের  মাধ্যমে ভিডিও করে ফেসবুকে প্রচার করেছে তাদের মানসিকতাকে আমলে নিতে হবে। তাদের এই সাহসের উৎসকে যদি আমলে না নেওয়া হয় তাহলে এমন অপরাধ ঘটতেই থাকবে। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো অপরাধীরা বেড়ে ওঠে প্রশাসনেরই আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। ধর্ষণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে একটাই উপায় আছে আর তা হচ্ছে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। প্রচলিত আইনের সকল সীমাবদ্ধতাকে কাটানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া এবং ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইনের সংশোধন করা।

লেখক: কলামিস্ট

 
/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ