‘যুগের হাওয়া’ বলে একটা কথা আছে। যুগের হাওয়ার সঙ্গে নাকি তাল মেলাতে হয়। কিন্তু বুঝতে হবে, যুগের হাওয়া সবসময় ভালো নয়। যুগের হাওয়ার সাথে মিশে থাকে ‘বদ হাওয়া’ও। এখন যুগটা ডিজিটাল। সবার হাতে হাতে স্মার্ট ডিভাইস। আমরা হলাম ‘স্যান্ডউইচ প্রজন্ম’। আমরা ইন্টারনেটবিহীন জীবনও দেখেছি, যেটা এখনকার প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না। কোনও কারণে ইন্টারনেট ডাউন থাকলে অচল হয়ে যায় গোটা দেশ। ইন্টারনেট যেমন বিশাল সম্ভাবনা, তেমনই ভয়ঙ্কর সমস্যাও। ইন্টারনেট মানে আপনার হাতে বিশ্বের অগাধ জ্ঞানভাণ্ডারের চাবি, আবার ইন্টারনেট মানেই ভয়াল এক অন্ধকার জগত।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ে নানা দ্বিধা-সংশয় আছে। কোন বয়সে শিশুর হাতে আপনি স্মার্ট ডিভাইস তুলে দেবেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা অভিভাবকরা নিজেদের ব্যস্ততার অজুহাতে শিশুদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস তুলে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সারি। তারপর যখন সেই শিশু স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত হয়ে যায়; মোবাইল ছাড়া খেতে চায় না, পড়তে চায় না; তখন গেলো গেলো রব তুলি।
আপনারা সন্তান মোবাইল ছাড়া খেতে পারে না, এই অভিযোগটা করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, সেই শিশুটিকে মোবাইল ফোন চেনালো কে? ঘরে ঘরে এখন অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের সমস্যার মূলে এই স্মার্ট ডিভাইস। আমার ছেলে প্রসূন এখন কলেজে পড়ে। তার মোবাইল এবং কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে টানাপড়েন নিত্যদিনের।
করোনা এসে এই টানাপড়েন বাড়িয়ে দিয়েছে আরো। প্রায় ১৫ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। পড়াশোনা যা হয় তা অনলাইনে, এই স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে। তাই যেসব অভিভাবক অনেক কষ্টে তার সন্তানকে স্মার্ট ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন, তারাও এখন বাধ্য হয়ে সন্তানের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব বা ডেস্কটপ তুলে দিয়েছেন। এসব যন্ত্রেই তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো বাধটা একবার ভেঙে গেলে প্রবল স্রোতে পানি যেমন আসে, আসে বালি, আসে কচুরিপানাও। বাধভাঙা স্রোতে ফিল্টার বসানো কঠিন, আসলে অসম্ভবও। আপনার সন্তান কতক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহার করছে, তার কতটা পড়াশোনার জন্য, কতটা পড়াশোনার বাইরে? আগে যেমন আমরা পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে আউটবই পড়তাম, এখনও স্মার্ট প্রজন্ম পড়াশোনার পাশাপাশি ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করে। আর ইন্টারনেট মানেই পদে পদে প্রলোভন, পদে পদে ফাঁদ। শিশুমন তার কতটা উপেক্ষা করতে পারে।
আগেই বলেছি, ইন্টারনেট মানেই আপনার সামনে জ্ঞানের অগাধ সাগর। আপনার মনের সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন মুহূর্তেই। আবার এই ইন্টারনেটেই রয়েছে নানান অশ্লীল সাইট, বিপদজনক সব গেম, টিকটক, লাইকি, মাদক বেচাকেনা, কিশোর গ্যাং- সবকিছু। ডার্কওয়েব নামে এক ভয়ংকর জগতের কথা শুনি, ভালো বুঝি না, তবে যেটুকু বুঝি তাতে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায় মেরুদণ্ডে। কার সন্তান কখন, কোন ফাঁদে পড়ে যায়, সেই শংকায় থাকি। কম্পিউটারের শুরুর দিকে গাড়ি চালানো, দাবা, লুডু খেলা বা ইটের দেয়াল ভাঙার মতো নিরীহ গেম ছিল। এখন পাবজি, ফ্রি ফায়ার ইত্যাদি নানান নামের ভয়ংকর সব খেলার নাম শুনি; যার পুরোটাই যুদ্ধ, হত্যা আর ধ্বংসের। কয়েকদিন আগে একটা গেম তো মানুষকে আত্মহত্যা পর্যন্ত টেনে নিয়েছে। প্রসূন দেখি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিলে অনলাইনে কী একটা গেম খেলে, যাতে সারাক্ষণই গোলাগুলি।
আমরাও ছেলেবেলায় পড়াশোনায় ফাঁকি দিতে নানান কৌশল বের করতাম। একটু জ্বর বাধাতে পারলেই মোটামুটি ৩/৪ দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। বইয়ের নিচে লুকিয়ে মাসুদ রানা বা ফাল্গুনী-নীহাররঞ্জন পড়তাম। আর বিকেল হলেই মাঠে ভো দৌড়। ফুটবল, সাত চারা, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, গোল্লাছুট, কুতকুত- কত রকমের মজাদার খেলা। দৌড়াদৌড়িম হৈচৈ, মারামারি- আহা আনন্দের শৈশব। তবে শর্ত ছিল, যাই করি মাগরিবের আজান শেষ হওয়ার আগে বাসায় ফিরতে হবে। এমনও হয়েছে আজান শুরু হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে খেলা বন্ধ করে এক দৌড়ে আজান শেষ হওয়ার আগেই বাসায় পৌঁছে গেছি। মাগরিবের আজান শুরু থেকে শেষে সে দৌড়ে উসাইন বোল্টও পারবেন না। এখন আমাদের সন্তানদের শৈশব নেই, মাঠ নেই, খেলা নেই, বন্ধু-বান্ধবও নেই। যা আছে সব ভার্চুয়াল। এখন আর কোনও সময়ের কোনও বাধাধরা নিয়ম নেই। গভীর রাত পর্যন্ত দেখি বন্ধু-বান্ধবরা অনলাইনে আড্ডা দিচ্ছে, অনলাইন একসঙ্গে খেলা দেখছে বা সিনেমা দেখছে।
আমরা ছেলেবেলায় সমবয়সী বন্ধু বা কাজিনরা একত্রিত হলে হুল্লোড় করতাম, পাড়া মাতাতাম। আর এখন সব চুপচাপ। বন্ধু-বান্ধবরা একত্রিত হচ্ছে ঠিকই, তারপর সবাই ঘাড় গুজে স্মার্ট ডিভাইসে ব্যস্ত। পাশের অ্যাকচুয়াল বন্ধুকে ফেলে আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই দূরের না দেখা ভার্চুয়াল বন্ধুর সাথে চ্যাটিংয়ে। আগে প্রেম হতো, একটু দেখা, একটু ছোঁয়া, প্রেমপত্র, তাতে আবার গোলাপের পাপড়ি লুকানো। এখন এসব কিছুই লাগে না। ফেসবুকেই প্রেম-বিয়ে সব হয়ে যায়, প্রতারণা হয়, ছাড়াছাড়ি হয়; সবই দ্রুতগতিতে। এই যে এখন নানান রকমের মাদকের নাম শুনি। নানান কিশোর গ্যাংয়ের গল্প শুনি, শিশু-কিশোরদের নানান অপরাধের কথা শুনি। শেষ পর্যন্ত সবকিছুর উৎস এই ইন্টারনেট।
দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, সবার হাতে হাতে স্মার্ট ডিভাইস, কথায় কথায় ইংরেজি বলছে। বাহ, দেশ বুঝি এড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বুঝি দারুণ স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কেন যেন ভয় হয়, শঙ্কা হয়। এই ঘাড় গোজা প্রজন্ম সত্যি স্মার্ট হচ্ছে তো। ভার্চুয়াল জগতে হাতিঘোড়া মেরে ফেলা আর বাস্তবে ছোট একটা সমস্যার সমাধান করার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এই যে ১৫ মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাতে কিন্তু একটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে যতই পড়াশোনা হোক, তা কখনও স্কুলের বিকল্প নয়। অনলাইনে আপনি পন্ডিত বানাতে পারবেন, স্মার্ট বানাতে পারবেন না। একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ বানানোর জন্য পরিবারের পরই সবচেয়ে বড় অবদান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে শুধু ক্লাসরুমে শিক্ষা নয়। স্কুল-কলেজে আসলে জীবন শেখানো হয়। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেশা, নেতৃত্বের বিকাশ, সামাজিক কাজে এগিয়ে যাওয়া সব হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বন্ধুর বিপদে এগিয়ে যাওয়াটা স্মার্টনেস, ঘাড় গুজে স্মার্ট ডিভাইসে চ্যাট করাটা স্মার্টনেস নয়। নতুন প্রজন্ম স্মার্ট ডিভাইসে বিভোর হয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, ঘাড় তুলে সামনের জগতটা তার কাছে অচেনা মনে হয়। বই পড়ে নিজের মতো একটা কল্পনার জগৎ বানানোর যে আনন্দ, স্মার্ট ডিভাইসে তা নেই।
এখন আর নতুন প্রজন্মকে স্মার্ট ডিভাইস থেকে দূরে রাখার সুযোগ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার জন্য হলেও তার হাতে স্মার্ট ডিভাইস দিতেই হবে। আর স্কুল-কলেজ কবে খুলবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই সন্তান স্মার্ট ডিভাইসে কী করছে, কোন সাইটে যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে তার ওপর নজরদারি জারি রাখতে হবে। অন্তত প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সন্তানকে নিরাপদ রাখা আপনার দায়িত্ব। আর চেষ্টা করুন আপনার সন্তান যেন সারাদিন কম্পিউটার গেমস না খেলে একটা সময় মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ পায়, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সরাসরি মেশার সুযোগ পায়। শুধু ডিভাইসে নয়, আমাদের প্রজন্ম যেন সত্যি সত্যি স্মার্ট হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ