X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী তর্কের লাভ-ক্ষতি

আমীন আল রশীদ
১৪ জুলাই ২০২১, ১৬:৩৬আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২১, ১৬:৪১
আমীন আল রশীদ যিনি বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন—সাধারণ অর্থে তিনিই বুদ্ধিজীবী। কারণ, বুদ্ধি না থাকলে জীবিকা অর্জন করা কঠিন। যিনি মাথা না খাটিয়ে কেবলই শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে জীবিকা অর্জন করেন, সেখানেও তাকে কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হয়। মানে বুদ্ধি খাটাতে হয়। সেই অর্থে একজন গৃহকর্মীও বুদ্ধিজীবী। কারণ, বঁটি দিয়ে মাছ কাটতে গেলেও সেখানে বুদ্ধি খাটাতে হয়। না হলে হাত রক্তাক্ত হবে।

কিন্তু তারপরও সমাজের সবাইকে বুদ্ধিজীবী বলা হয় না। বুদ্ধিজীবী বলতে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে বোঝানো হয়। আবার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও শ্রেণিবিন্যাস থাকে। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী বলে কোনও গোষ্ঠী আদৌ দৃশ্যমান কিনা—তা নিয়েও তর্ক আছে। সেই তর্কের মধ্যেই নতুন করে বিষয়টি সামনে এনেছেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ। তিনি ষাট বছরের কম বয়স, এরকম ৬১ জনের একটি তালিকা ফেসবুকে শেয়ার করে তাদের ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সেই তালিকার ২৫ নম্বরে তার নিজের নামটিও রয়েছে। নিজেকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া নিঃসন্দেহে সাহসের ব্যাপার। আপনি সেটি নিয়ে রসিকতা করতেই পারেন।

তালিকায় অধ্যাপক আজফার হোসেন, অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নাম যেমন রয়েছে, তেমনি ব্রাত্য রাইসু ও পিনাকী ভট্টাচার্যের মতো লেখকও রয়েছেন। সুতরাং, মাহবুব মোর্শেদ যে নিতান্ত নিষ্পাপ একটি উদ্দেশ্যে তালিকাটি করেছেন, সেটি ভাবার কোনও কারণ নেই। এটি নিছকই রসিকতার ব্যাপার হলে তালিকায় হিরো আলমের নামও থাকতো। কিন্তু তা যেহেতু নেই, ফলে এটি ধরেই নেওয়া যায় যে তিনি সিরিয়াসলি এই তালিকাটি করেছেন এবং এই পোস্টটি যারা দেখেছেন তাদেরও অনেকে বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই ফেসবুকের এই পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় সমালোচনা। সেই সমালোচনার সূত্র ধরে একটি দৈনিক পত্রিকা ‘বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড়’ শিরোনামে একটি সংবাদও প্রকাশ করে। তার মানে বিষয়টি গণমাধ্যমেরও নজর কেড়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্যা (মুশকিল) হলো, এখানে কে যে কখন তারকা হয়ে যায়, তা আগেভাগে আন্দাজ করা যায় না। যেমন হিরো আলমও এখন তারকা। ফলে কে কখন কী লিখে, বলে বা করে বুদ্ধিজীবী হয়ে যান বা যাবেন, সেটি এক বিরাট রহস্য। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষের যে গড় সাংস্কৃতিক মান, তাতে এখানে তারা কখন যে কোন বিষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং কাকে গাছে তুলবে—তাও আগেভাগে ঠাওর করা যায় না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সিরিয়াস বিষয়ের নিচে লাইক ও মন্তব্যের যে সংখ্যা, তা কয়েকশ’ গুণ ছাড়িয়ে যায় হালকা, চটুল, বিভ্রান্তিকর বা উদ্ভট বিষয়ের কোনও পোস্টের ক্ষেত্রে। তার মানে মানুষ ইয়ার্কি-ফাজলামো এবং স্যাটায়ারই বেশি পছন্দ করে? স্যাটায়ার করতে করতে হিরো আলম যে ফাঁকতালে সত্যিই সোশ্যাল মিডিয়ার হিরো হয়ে গেছেন এবং পাবলিক তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ ও রসিকতা করলেও তিনি যে ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন, সেটি অনেকেই খেয়াল করেন না। বরং এটিই তার সফলতা। অর্থাৎ তাকে নিয়ে যত বেশি ব্যঙ্গ ও রসিকতা, ততই তার লাভ।

বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়েও তাই হচ্ছে। যেসব লোকের নাম মানুষ জানতো না, তাদেরও অনেকে এখন এই কথিত বুদ্ধিজীবীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা আলোচনায় আসছেন। রসিকতা বা ব্যঙ্গার্থে হলেও তাদের নামটি মানুষ জানছে। একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদও যেহেতু প্রকাশিত হয়েছে, তার মানে এক ধরনের স্বীকৃতিও মিললো। সুতরাং বিষয়টিকে স্যাটায়ার করে উড়িয়ে দেওয়া হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি কুফল সম্পর্কেও সচেতন থাকা দরকার। কারণ, কোন দেশে কোন সময়ে কে বুদ্ধিজীবী—এটি তালিকা করে বলার বিষয় নয়।

অস্বীকার করা যাবে না, যেকোনও তালিকার পেছনেই একটা রাজনীতি থাকে। বাংলাদেশে প্রথম বুদ্ধিজীবীর তালিকা করা হয়েছিল একটি অসৎ উদ্দেশ্যে, ১৯৭১ সালে। পাক হানাদাররা সেই তালিকা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য। এর বহু বছর পরে ব্লগারদের তালিকা করা হয়েছিল। সেই তালিকা ঘাতকদের সাহায্য করেছিল তাদের অনেককে হত্যা করতে। আবার সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে বেশ কয়েকজনের ছবিসহ একটি ব্যানার টানিয়ে তাদের প্রতিহত করার কথাও বলা হয়েছিল। তার মানে এরকম প্রত্যেকটির তালিকার পেছনে একটি খারাপ উদ্দেশ্য থাকে। এইবার বুদ্ধিজীবীদের কথিত তালিকার পেছনেও আসলে পারস্পরিক পিঠ চুলকানো এবং কিছু লোককে সমাজে বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই যে মূল উদ্দেশ্য, তাতে সন্দেহ কম।

বিষয়টা এরকম যে, একজন তার পছন্দের লোকদের নিয়ে তালিকা করলেন, আরেকজন আবার তার পছন্দের লোকদের নিয়ে করবেন। কিন্তু এই তালিকাবাজির দ্বারা আখেরে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনও ফায়দা হবে না। কারণ, কে কত বড় বুদ্ধিজীবী—মানুষ সেটি তালিকা দেখে বিবেচনা করে না। নোয়াম চমস্কির নাম মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় না থাকলে তাতে তার কিছু যায় আসে না। আবার বাংলাদেশের যে ৬১ জনের নাম দিয়ে তালিকা করা হলো, তাতে এই তালিকার অনেকে খুশি হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে অনেকে বিব্রতও হয়েছেন। তালিকার এক নম্বরে রাখা হয়েছে যে অধ্যাপক আজফার হোসেনকে, ফেসবুক লাইভে এসে বলেছেন তিনি এই ধরনের তালিকার বিরোধী এবং তিনি এটি ডিসওউন করেন। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে এই তালিকায় এমন অনেকের নাম আছে যাদের সঙ্গে আজফার হোসেন নিজের নামটি দেখতে চান না। আবার তিনি প্রকৃত অর্থে একজন বুদ্ধিজীবী হলেও তার কাছে এ জাতীয় তালিকার যে কোনও গুরুত্ব নেই বা তিনি এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, সেটি জানানোর জন্যই ফেসবুক লাইভে এসে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন।
এটিও ঠিক, প্রকৃত অর্থেই যারা বুদ্ধিজীবী, তাদের সঙ্গে যারা বুদ্ধিজীবী নন, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার মানে হলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের অসম্মানিত করা। এখন কে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আর কে নন—সেটি কে নির্ধারণ করবেন? রাষ্ট্র তো এই দায়িত্ব কাউকে দেয়নি। কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এরকম তালিকা করলে সেটিকে খুব বেশি আমলে নেওয়ারও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরও যেহেতু বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে—তাই এত কথা বলা।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুকে পারস্পরিক পিঠ চুলকানোর একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেটের লোকেরা পরস্পরকে হিরো বানানোর ধান্দায় থাকেন। তারা প্রতিপক্ষকে আক্রমণও করেন সম্মিলিতভাবে। এসবের পেছনে আরেকটি বড় উদ্দেশ্য থাকে পুরস্কার বাগানো। অর্থাৎ কোনও একজন লেখককে তার সিন্ডিকেটের লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করেন, যাতে পাঠকের মনে হবে ওই লেখকের বই না পড়লে জীবনের ষোলো আনাই বৃথা। এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর এক ধরনের নৈতিক চাপও তৈরি করে। বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরির পেছনেও এরকম কোনও উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে।

২.

সমাজে বুদ্ধিজীবী বলতে শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখকদের এমন একটি অংশকে বোঝানো হয়, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের পক্ষে (সরকারের বিপক্ষে গেলেও) কথা বলেন ও লেখেন। কিন্তু এখন শিক্ষক ও সাংবাদিকদের বড় অংশই নিশ্চুপ অথবা তারা দীর্ঘদিন ভয়ের সংস্কৃতির ভেতরে বসবাসের কারণে হয় জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে চুপ থাকেন অথবা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র থিওরিতে এমনভাবে কথা বলেন ও লেখেন, যা আখেরে কোনও সমাধান দেয় না। অনেকে সরাসরি ক্ষমতার পক্ষেই দাঁড়ান। এখানে কখনও যেমন ভয় কাজ করে, তেমনি জাগতিক নানা স্বার্থ বা লোভও থাকে। সবার পক্ষে লোভের ঊর্ধ্বে ওঠা কঠিন। আবার যারা এসব লোভ ও ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকতে চান, তাদের অনেককেই নানারকম জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এখন অনেক সময়ই রাজনীতিবিদের দলীয় বক্তব্যের সঙ্গে শিক্ষক-সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীদের ভাষার কোনও তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না। সবার সুর এক। যেন সবার স্বার্থ অভিন্ন। কারও মধ্যে কোনও গভীরতা নেই। ভিন্ন চোখে দেখার বা বলার সাহস কমে যাচ্ছে। সুতরাং, সমাজে যাদের বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করার কথা, তারা যখন আর সেই কাজটি করতে পারছেন না বা সংখ্যাটি ক্রমশ কমছে—তখন সেই শূন্য গোয়ালে দুষ্টু গরুদের আনাগোনা শুরু হবে—এটিই স্বাভাবিক। অর্থাৎ মানুষ যখন দেখে যে, যখন যে কথাটি বলা দরকার, সেটি শিক্ষক-সাংবাদিক বা রাজনীতিবিদরা বলছেন না, তখন তার কাছাকাছি কোনও কথাও যখন অন্য কেউ বলেন, মানুষ তখন মনে করে, এই লোকটি তো ভালোই কথা বলছেন। তখন তার চটকদারি কথায়ও মানুষ আকৃষ্ট হয়। তখন তিনি দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং তখন তাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার করে নিতেও দ্বিধা করে না। যে কারণে টেলিভিশনের টকশোতে সাহেদের মতো একজন ‘ফটকাবাজ’ও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক মানুষ তার কথায় মুগ্ধ হয়। তাকে আইডল মনে করে। অর্থাৎ মানুষের সামনে যখন কোনও আইডল থাকে না, তখন যে কেউ আইডল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। যখন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীর সংকট তৈরি হয়, তখন বুদ্ধিজীবী হিসেবে এমন সব লোকের নাম সামনে চলে আসে, যাদের অনেককে নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করে। ফলে একটি সিরিয়াস বিষয় তখন রসিকতায় পর্যবসিত হয়।

শুধু এই বুদ্ধিজীবিতার বিষয় নয়, খেয়াল করলে দেখা যাবে এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সবগুলো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতাই করে। গরিব মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়লে তা নিয়ে যেমন রসিকতা করে, তেমনি করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেলে তা নিয়েও রসিকতা করে। অর্থাৎ কেউ প্রতিবাদ করে সামনে আসে না। কারণ, সে জানে প্রতিবাদ করলে নানারকম বিপদে পড়ার শঙ্কা আছে। অতএব, বিপদে পড়ার ঝুঁকি না নিয়ে মানুষ শুধু রসিকতাই করে।  

লেখক: সাংবাদিক।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
সাত দিনে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদফতর
সাত দিনে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদফতর
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ