রোজার ঈদে মানুষ যখন টারজান হয়ে বাড়ি ফিরছিল তখন কিছু মহাজ্ঞানী মানুষ এই বলে আগুন লাগিয়ে বলল, ‘প্লেন চলছে, বড়লোকদেরই কেন ঈদ? গরিবের কি ঈদ নেই?’ ওর থাকলে কেন আমার থাকবে না! এমন মানসিকতা অনেকটাই নীচ।
তো সেসব মানুষ এসি রুমে বসে দেশের বৈষম্য দূর করতে লাগলেন। মানুষকে কেন বাড়ি ফিরতে দেওয়া হবে না, কেন মানুষ আনন্দ করবে না– তীব্র জ্বালাময়ী সব আবেগী কথা। অথচ এসব মানুষ ঠিকই জানে প্লেনে করে বাড়ি গেলে কতজন যাবে?
তাদের সুরক্ষা বিমানই করবে, যারা যাবে তারাও সচেতন। কয়েক হাজার মানুষ প্লেনে যাতায়াত করবে বলে তাদের সঙ্গে এই কোটি মানুষকে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে– এই অযৌক্তিক চিন্তা তাদের মাথায় এলো। সঙ্গে তো আছেই আমাদের ‘জীবিকা’ নামের মহামূল্যবান শব্দ। করোনাকালে কেবল আমার দেশেই জীবিকা সবচেয়ে মূল্যবান হতে দেখেছি, আমি যদিও জানতাম জীবন মূল্যবান।
তাদের এই চিন্তার ফল গুনছি আমরা এক মাস ধরে। ৬ শতাংশে নেমে যাওয়া করোনার সংক্রমণ এখন ৩০ শতাংশ! ১ মাসে মারা গেছে ৩ হাজার ৭০০ মানুষ। কেবল রোজার ঈদে মানুষ বাড়ি গেলো বলে, তাও তখন চলছিল লকডাউন। ২০ থেকে ২১ লাখ মানুষ ছড়ালো পুরো দেশে। আর পুরো দেশে করোনা বাড়লো পাঁচগুণ। এরপরও ঈদে সবাইকে বাড়ি যেতে দেওয়া হলো, খুলে দেওয়া হলো সব। সবই। তাও ঈদে!
মানুষের নাকি টাকা নেই। খাবারের টাকা জোগাড় না করতে পেরে হিমশিম অবস্থা। শপিং সেন্টার সেটা বললো না। মার্কেট খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় আছড়ে পড়লো সেখানে। মনে হতে থাকলো মার্কেট না ধসে যায়। এত টাকা আসে কোথা থেকে?
রাস্তায় গরুর হাট আর গরু কেনার বহর দেখে আপনি কোনও দিনই বুঝতে পারবেন না কার আসলে টাকা নেই! কোথায় জীবিকার সংকট!
বাস, লঞ্চ বা প্লেনে ৩/৪ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যারা টিকিট কাটছে তাদের কোথায় টাকার অভাব? অথচ না খেয়ে মরে যাবে সব, এই অজুহাতে দেড় বছর ধরে দফায় দফায় পঙ্গু লকডাউন পালন করা হচ্ছে। মানুষ যখন খেতে পায় না, যখন তীব্র অর্থ সংকটে পড়ে, তখন কোনোভাবেই তার মন-মাথা উৎসবে সায় দেয় না। সে যেখানে বসবাস করে সেখানেই পড়ে থাকে। বাড়ি গিয়ে ঈদ করবো এই মনটাই তার থাকে না। বিশ্বাস করেন, উৎসবে মন থাকে না পেটে খাবার না থাকলে।
তো ঈদে আসলে জীবিকা না, আবেগ প্রধান হলো। এই দেশের মানুষের আবেগের কমতি নেই। মৃত্যু সামনে জেনেও তারা রওনা হয়েছেন বাসে, ট্রেনে, ট্রাকে, হেঁটে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে করে। যে অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রোগী নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়।
সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক চিত্র দেশজুড়ে। রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। উত্তরবঙ্গের জ্যাম ঠেকেছে ঢাকার বনানী এসে। গতকাল যারা রওনা হয়েছেন আজও পার হতে পারেনি যমুনা সেতু। কেউ নড়তে পারছেন না। রাস্তায় রাস্তায় কোরবানির হাট। গায়ে গা লাগানো সব, কেউ দেখছেন না। কারও মুখে মাস্ক নেই। দূরত্ব তো অনেক দূরে!
বাস লঞ্চ সব উপচে পড়ছে মানুষে। অথচ বারবারই বাস মালিক, লঞ্চ মালিকরা দাবি করে আসছেন, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে সরকারের সব নির্দেশনা মেনে তারা ছাড়তে চায় বাহন। ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ, পাঁচগুণ কিন্তু যাত্রীও অর্ধেকের বদলে দ্বিগুণ, তিনগুণ, পাঁচগুণ...।
দীর্ঘ জটে বসে থাকা সীমাহীন দুর্ভোগে মানুষ। সর্বত্র অব্যবস্থাপনা, অরাজকতা। আমরা কি জানতাম না যে এই ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করার আমাদের সক্ষমতা নেই? আমরা কি জানি না মানুষকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না? আমরা কি জানি না সংক্রমণ কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? অবুঝ কিছু মানুষের আবেগে কেমন করে আমাদের মাথা আমরা বেচে দিলাম?
মানুষগুলো যখন মরবে, মরতেই থাকবে, সেই দায় কার? তার আবেগের নাকি আপনার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার? আপনার অব্যবস্থাপনার? নাকি আপনার অক্ষমতার?
প্রশ্নের উত্তর জানতে বসে আছি।
লেখক: সাংবাদিক