X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকতা বনাম করপোরেট ইমেজ

মো. সামসুল ইসলাম
৩০ জুলাই ২০২১, ১৮:৪২আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২১, ১৮:৪২

মো. সামসুল ইসলাম সম্প্রতি আমাদের দেশের সাংবাদিকতা যে কারণে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বা সমালোচিত হচ্ছে তাহলো ব্র্যান্ড বা করপোরেট ইমেজ রক্ষায় সাংবাদিকদের ভূমিকা। যেকোনও কারণে কোনও করপোরেট হাউজ যখন বিতর্কিত হয়, তখন কোনও কোনও গণমাধ্যমের করপোরেট ইমেজ রক্ষার প্রচেষ্টা আমাদের জনগণ স্বভাবতই মেনে নিতে পারেন না। অনেকে ক্ষেত্রেই তারা, কিছুটা অযৌক্তিকভাবেই, ব্যক্তি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন।

করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ইমেজ রক্ষার কাজ আর সাংবাদিকতা দুটি ভিন্ন পেশা। গণতন্ত্র আর উদার অর্থনীতির যুগে মুক্ত গণমাধ্যম যেমন অপরিহার্য, তেমনি অপরিহার্য ব্যবসায়িক বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ।

বিতর্ক এড়াতে সঙ্গত কারণেই আমি আমাদের দেশের কোনও উদাহরণ টানতে চাই না। কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে কোনও প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ বা প্রধান নির্বাহী বা অন্য কেউ যখন বিতর্কিত হয়ে পড়েন বা অপরাধ করেন তখন সেই প্রতিষ্ঠানকে কেউ হয়তো ধ্বংস করে দিতে চাইবেন না। হাজার হাজার মানুষ সেখানে চাকরি করছেন। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে সেটি গড়ে উঠেছে। সবাই চাইবেন অভিযুক্ত ব্যক্তি যাতে আইনের আওতায় আসে। কিন্তু ব্র্যান্ড বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে।  

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক্ষেত্রে ব্র্যান্ড বা করপোরেশনের ইমেজ কে রক্ষা করবে? করপোরেট কমিউনিকেশনের নির্বাহীরা? নাকি সাংবাদিকরা? ব্র্যান্ড বা করপোরেট ইমেজ রক্ষার ব্যাপারটি একটি বিশেষায়িত কাজ। গণমাধ্যমকে বিতর্কিত না করে নৈতিকতা অক্ষুণ্ণ রেখেও এটা করার প্রচেষ্টা নেওয়া যায়।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেখানে এই সেমিস্টারে যে কয়েকটা কোর্স পড়াচ্ছি তার মধ্যে একটি কোর্স হচ্ছে করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স।  যদিও পশ্চিমা টেক্সবইগুলোতে করপোরেট কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ইথিক্যাল প্র্যাকটিসের কথা উল্লেখ করা হয় কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই কোর্স পড়াতে গেলে বিব্রত হতে হয়। যেমন, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা অন্য কোর্সে মিডিয়ার যে কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি শিখে আসে তার উল্টো চিত্র চলে আসে এ কোর্সে এসে।

সেটা হয় বাংলাদেশের কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য। যেমন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের যারা মালিকানায় আছেন বা শীর্ষ নির্বাহীরা যখন কোনও অপরাধ করেন বা সেসব প্রতিষ্ঠানে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তখন সাংবাদিকতা আর করপোরেট কমিউনিকেশনের দায়িত্ব কিন্তু ভিন্ন।

সাংবাদিকতার আদর্শ অনুসারে সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে পাঠক, দর্শককে সঠিক তথ্য জানাবেন।  আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশনের নির্বাহীরা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বা ব্র্যান্ড ও ইমেজ রক্ষার চেষ্টা করবেন। এগুলোর সুনির্দিষ্ট কৌশল আছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশন বা পাবলিক রিলেশন্সের লোকজন এসব কৌশল জানেন বলে আমরা ধরে নিতে পারি এবং তারা বিভিন্নভাবে এ সংকট কাটানোর ব্যাপারে টপ ম্যানেজমেন্টকে ধারণা দেবেন। ভুল স্বীকার বা জনগণকে সঠিক তথা দেওয়া, দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা বা ক্ষেত্র বিশেষে নিশ্চুপ থাকাসহ বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল তার নিতে পারেন প্রতিষ্ঠানের ইমেজ রক্ষার্থে।    

আমি কিন্তু এখানে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের ইমেজ রক্ষার কথা বলছি। কোনও ব্যক্তিকে তার অপরাধের জন্য আইনের হাত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলছি না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান কোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়াকে ভুলভাবে ব্যবহার করে সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলেন এবং নিজেদের বিপদ বাড়ান। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ইমেজ রক্ষার্থে সাংবাদিকতা ভুলে করপোরেট কমিউনিকেশনের অংশ হয়ে যান। গণমাধ্যমের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা উলটো ব্র্যান্ড প্রটেকশনের জন্য মাঠে নামেন সাংবাদিকতার রীতিনীতি ভুলে।

সম্প্রতি আমরা এরকম অনেক উদাহরণ আমাদের দেশেই দেখছি। দেশে জনগণের মিডিয়া লিটারেসি বা গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা বাড়ছে। জনগণ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ঘটনা প্রবাহ অন্যদিকে নেওয়ার প্রচেষ্টায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কি কোনও লাভ হয়? বা তাদের ইমেজ সুরক্ষিত হয়? আমার মনে হয় না। জনগণ এখন অনেক সচেতন।  

সাংবাদিকতা পেশার স্বতন্ত্র সীমারেখা নির্ণয় করা তাই জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক পেশার সঙ্গেই জড়িয়ে পড়ছে তাদের নাম। তবে এ সমস্যা যে শুধু আমাদের দেশের তা নয়।  ধনতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের রাজধানীগুলো লবিস্ট গ্রুপ আর পিআর ফার্মে ভর্তি। এর ঢেউ এসে পড়েছে আমাদের দেশেও। মিডিয়াকে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়। মিডিয়াতে যা প্রকাশিত হয় তার কতটুকু অন্যের স্বার্থ রক্ষার্থে আর কতটুকু জনগণের জন্য তা আসলে বিশাল প্রশ্ন।

বিভিন্ন দেশের অ্যাম্বাসি, এনজিও, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, নন প্রফিট অর্গানাইজেশন সবারই আসলে গণমাধ্যমকে দরকার। মিডিয়া কাভারেজ সবার অস্তিত্ব রক্ষায় জরুরি। নন প্রফিট অর্গানাইজেশনদের মিডিয়া কাভারেজ দেখিয়ে ফান্ড আনতে হয়। রাষ্ট্রদূতদের নিজ দেশে কাজকর্ম দেখাতে দরকার মিডিয়া কাভারেজ। সুতরাং এটা মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে উন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশেই পিআর ফার্ম গড়ে উঠছে। অর্থের বিনিময়ে তারা বিনিময়ে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া কাভারেজ নিশ্চিত করে।

এখানে লুকোনোর কিছু নেই। করপোরেট মিডিয়া বিশ্বব্যাপী এভাবেই কাজ করে। মিডিয়া তো অনেক দেশের ফরেন মিনিস্ট্রির এক্সটেনশন হিসেবে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে তারাই যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে জনগণ আগে মিডিয়ার ভেতরের এতকিছু জানতো না। এখন কিছুটা বুঝতে পারছে যে তারা আসলে কার বা কী খবর দেখছে। এটা জেনেই তারা ফেসবুকে মিডিয়া বা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে।

তবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের একটা পার্থক্য হলো সেসব দেশে অনেক সংগঠিত মিডিয়া ওয়াচ গ্রুপ বা মিডিয়া মনিটরিং এজেন্সি এবং সেই সঙ্গে ফ্যাক্ট চেকিং গ্রুপ থাকে। বিভিন্ন ইস্যুতে মিডিয়া কাভারেজের ব্যাপারে গণমাধ্যম সমালোচকরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন এবং তা জনগণের সামনে তুলে ধরেন।  আমাদের দেশে এরকম গঠনমূলক সমালোচনা খুব কমই হয়, যাতে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উপকৃত হতে পারেন। বরং যেটি হয় তাহলো ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে ব্যক্তি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কুৎসিত গালাগালি। সাংবাদিকরাও তো চাকরি করেন। অনেক ক্ষেত্রেই মিডিয়ার মালিকদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

সাংবাদিকতার অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের সাংবাদিকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যমের মালিক, সাংবাদিকদের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, ইউনিয়ন,  সবাইকে এটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে,  সবাইকে মিলে মিডিয়ার সেলফ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে সাংবাদিকতা পেশার স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা রক্ষিত হয়।

লেখক: কলামিস্ট; বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ