X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের পূর্ণকালীন শিক্ষক এবং ইন-হাউজ কাউন্সিলরদের সনদ

সাকিব রহমান
১৩ আগস্ট ২০২১, ১৮:২৬আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২১, ১৮:২৬

সাকিব রহমান সাধারণত যারা আইন বিষয়ে অনুশীলন করেন অর্থাৎ আইনজীবী, তাদের জন্যে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইনের পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করা আইনত নিষেধ। একইভাবে সনদধারী আইনের কোনও পূর্ণকালীন  শিক্ষকও পারেন না আদালতে আইন অনুশীলন করতে। এই বিষয়টির সমালোচনা করে ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বনাম এ. কে. এম. ফজলুল কারিম’ শিরোনামে ২০১৭ সালে বিবৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা উল্লেখ করেন, যারা আইন অনুশীলন করেন অর্থাৎ  আইনজীবী এবং যারা আইনের শিক্ষক বা পণ্ডিতজন তাদের মাঝে একটা সেতুবন্ধন থাকা বর্তমান সময়ে খুবই দরকার। তিনি বিষয়টিতে আরও জোর দিয়ে বলেন, ষাট বা সত্তরের দশকে আমরা দেখেছি যে আইনের বড় বড় শিক্ষকেরা আদালতে অহরহ শুনানি করতে পারতেন।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি যে, আইনজীবীদের জন্য প্রণয়নকৃত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের যে পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালা রয়েছে তার ৪নং অধ্যায়ের ৮নং ধারায় খুব শক্তভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে যে একজন আইনজীবী যিনি কোর্ট প্র্যাকটিস করেন তিনি কোনোভাবেই অন্য কোনও পেশা, চাকরি বা ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে পারবেন না। এবং এই পেশা ব্যতীত অন্য যে কোনও ধরনের চাকরি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত হতে পারবেন না। এমনকি এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সদস্য হওয়াও নিষেধ। সুতরাং যখনই বার কাউন্সিলের সনদধারী একজন আইনজীবী কোনও  বিশ্ববিদ্যালয় বা  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়মিত হন তখন তাকে তার ওই প্র্যাকটিসিং সনদটি স্থগিত রাখতে হয়। তিনি আর আদালতে অনুশীলন করতে পারেন না।    

উপরে উল্লেখিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের লিগ্যাল কমিউনিটি ও আইনাঙ্গনের জন্যে অশনি সংকেত। কারণ, আইনের শিক্ষার্থীদের মাঝে মেধা তালিকায় সম্মুখ সারিতে থাকা মেধাবী স্নাতকদের বেশিরভাগকেই শিক্ষকতা পেশায় দেখতে পাওয়া যায়। যার দরুন তারা তাদের মেধা দিয়ে লিগ্যাল কমিউনিটি বা আইন অনুশীলনে যুগান্তকারী কোনও অবদান ও মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেন না। সুতরাং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালার ৪নং অধ্যায়ের এই  ৮নং ধারাটি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই অযৌক্তিক। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় জানিয়ে রাখি, এই ধারাটি সনদধারী এসব আইনের শিক্ষকের পাশাপাশি  যেসব সনদধারী আইনজীবীরা ইন-হাউজ কাউন্সিলর তথা কোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন, তাদের কর্মকাণ্ডকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

বিষয়টি একটু খোলাসা করেই বলা যাক। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বড় বড় কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলোর নিজস্ব আইনি বিভাগ রয়েছে, যেখানে অনেক গুণী আইনজীবী কাজ করেন। এসব আইনজীবী এই কোম্পানিগুলোকে নিজ পার্টি বা খদ্দের হিসেবে ধরে মামলা পরিচালনা করেন না, তারা এই কোম্পানিগুলোর সব দলিলাদি ও কাগজপত্র নিয়মিত দেখাশোনা করেন এবং এই সূত্রে কোম্পানিগুলোর আইনি  বিভাগের সদস্য হিসেবে কোম্পানির নিয়োগকৃত অন্যান্য আইনজীবীর সঙ্গে কোম্পানি ও ব্যাংকগুলোর পক্ষে কোম্পানি মামলাগুলো পরিচালনা করেন। যাহোক, বিষয়টি হলো যখনই তারা কোম্পানি বা ব্যাংকে কাজ করেন তখনই তারা ওই ৮নং ধারায় উল্লেখিত বেতনভুক্ত পেশাজীবী বা কর্মচারীদের তালিকায় পড়ে যাচ্ছেন। এবং বার কাউন্সিলও আইনত বাধ্য তাদের প্র্যাকটিসিং সনদগুলো বাতিল করতে। যদিও বাস্তবে বার কাউন্সিল তাদের প্র্যাকটিসিং সনদ বাতিল করতে একদমই প্রস্তুত নয়। এমনকি তাদের এটা জানানও দেয় না যে আদলতে অনুশীলনকারী থাকা অবস্থায় এ ধরনের কাজে যুক্ত থাকলে তাদের সনদটি বাতিল হতে পারে।

আইনজীবীদের জন্য প্রণয়নকৃত বিধিমালাটির আলোকে বিবেচনা করলে একটি বিষয় কিন্তু দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের আদালতসমূহে অনুশীলনকারী সব আইনজীবীকেই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ তথা পেশাগতভাবে স্বাধীন থাকতে হবে। কিন্তু মজার বিষয়টি হলো, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের ল’চেম্বারগুলো যখন অ্যাসোসিয়েটস বা সহকারী হিসেবে সনদধারী আইনজীবীদের তাদের চেম্বারগুলোতে নিয়োগ দিচ্ছে, তখন বেতনভুক্ত সেই প্র্যাকটিসিং আইনজীবীরা কিন্তু সেই চেম্বারগুলোর কর্মচারীই হয়ে যাচ্ছে! তার মানে এসব নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী চেম্বারের অধীনে কাজ করার সময় তাদের সনদটি স্থগিত রাখতে আইনত বাধ্য! এভাবে, দিনশেষে ল’চেম্বারগুলোও আসলে বিধিটির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না! অবশ্য এই বিষয়টি এড়ানোর জন্য চেম্বারগুলো ‘কর্মচারী চুক্তি’ (ইমপ্লয়মেন্ট এগ্রিমেন্ট)-এর অধীনে নিয়োগ না দিয়ে ‘নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক আইনগত সহায়তা প্রদান চুক্তি’ (রিটেইনারশিপ এগ্রিমেন্ট)-এর অধীনে নিয়োগ দিয়ে খানিকটা পার পেতে পারে।

তুমুল মেধাবী এসব সনদধারী আইনের শিক্ষকদের আদালতের আইন অনুশীলন থেকে দূরে রাখতে হবে এমন কোনও  উদ্দেশ্য নিয়ে  হয়তো বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সে সময় এই  আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন করেনি। বাস্তবে এই বিধি বা আইনের উল্লেখিত ধারাটি কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের লিগ্যাল অ্যারিনার বিকাশে অন্তরায় হয়েই দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি গুণী আইনজীবী যারা একজন পেশাজীবী হিসেবেও আমাদের আইনি করপোরেট ও ব্যাংকিং সেক্টরে অবদান রাখতে পারেন তাদের পথকেও সংকুচিত করে দিচ্ছে। অথচ বর্তমান বিশ্বে এটি একটি সাধারণ বিষয় যে সনদধারী আইনজীবী  মাত্রই  একজন  ইন-হাউজ কাউন্সিলর অর্থাৎ তিনি কোনও কোম্পানি, ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমান  বাংলাদেশে কোম্পানি বা ব্যাংকগুলো যখন তাদের আইনি বিভাগে ইন-হাউজ কাউন্সিলর নিয়োগের জন্যে বিজ্ঞাপন দেয় তখন কিন্তু তারা সনদধারী আইনজীবীদের কথাই সেখানে উল্লেখ করে। এমনকি অনেক কোম্পানি এভাবেও বলে যে, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য উচ্চ আদালতে এত বছর অনুশীলন করা আইনজীবীরাই শুধু আবেদন করতে পারবে। যেখানে ইন-হাউজ কাউন্সিলর  হিসেবে ঢোকামাত্রই সনদটি স্থগিত রাখার আইনত একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসে সেখানে আসলে ওই সনদধারী চাওয়ার কি-ই বা আর যৌক্তিকতা থাকে!

সুতরাং এটা বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে,  আইনজীবীদের জন্য প্রণয়নকৃত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এই পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালাটিতে পরিবর্তন আনা অতীব জরুরি। কারণ, বিধিটির এই আলোচ্য ধারাটি আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমানে বিদ্যমান এই ধারাটির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়তো কিছু উপকারিতা বয়ে আনবে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগই বয়ে আনবে ভয়াবহ অপকারিতা।

 
লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টানা দাবদাহের পর রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি
টানা দাবদাহের পর রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি
বিশ্বকাপ নিয়ে বেশি মাতামাতি না করতে শান্তর অনুরোধ
বিশ্বকাপ নিয়ে বেশি মাতামাতি না করতে শান্তর অনুরোধ
আটলান্টিক মহাসাগরে পাওয়া ৯ মরদেহের পরিচয় নিয়ে যা বললো ব্রাজিল
আটলান্টিক মহাসাগরে পাওয়া ৯ মরদেহের পরিচয় নিয়ে যা বললো ব্রাজিল
দুর্গাসাগরে ডুবে পুণ্যস্নানে আসা কলেজছাত্রের মৃত্যু
দুর্গাসাগরে ডুবে পুণ্যস্নানে আসা কলেজছাত্রের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ