X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্বৃত্তরাই আফগানিস্তানে সরকার চালাবে

ফারাজী আজমল হোসেন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৭আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৭
ফারাজী আজমল হোসেন আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রীদের নাম ঘোষণার মাধ্যমেই গোটা দুনিয়াকে নিজেদের স্বরূপ চিনিয়ে দিয়েছে তালেবানরা। দুর্বৃত্তরাই যে আফগানিস্তানে সরকার চালাবে এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ৩৩ সদস্যের তালেবান মন্ত্রিসভার ১৭ জনই রয়েছেন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তালিকায়।

বেশিরভাগ মন্ত্রীকেই আমেরিকা জঙ্গিবাদী বলে মনে করে। নামে সম্মিলিত আফগান সরকার হলেও তালেবান মন্ত্রিসভায় পশতুনদেরই রমরমা। আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ হচ্ছেন পশতুনরা। কিন্তু মন্ত্রিসভার ৩৩ জনের মধ্যে ৩০ জনই পশতুন। শতাংশের হিসাবে ৯০ শতাংশ। ৪৫ শতাংশ তাজিক এবং উজবেক জনসংখ্যা থাকলেও তাদের প্রতিনিধি মাত্র ৩ জন। ১০ শতাংশ শিয়া, ৪৮ শতাংশ নারী, তুর্কমেন ও বালুচদের ৫-৬ শতাংশ জনসংখ্যা থাকলেও তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। ফলে মন্ত্রিসভায় সব অংশের আফগানদের অন্তর্ভুক্তির দাবি এলে বাস্তব পরিস্থিতির বিপরীত।

তালেবান ও তাদের সমর্থকরাই শুধু মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছে। বাকিদের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে জঙ্গিবাদী সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্ককে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিসভায়। ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন হাক্কানিরাই। আফগানিস্তানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে সিরাজউদ্দিন হাক্কানিকে। এই সিরাজউদ্দিনের মাথার দাম ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। সিরাজউদ্দিন ছাড়াও আবুল বাকী হাক্কানি উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, মৌলভী নজিবুল্লাহ হাক্কানি টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, খলিল-উর-রেহমান হাক্কানি শরণার্থী মন্ত্রী এবং আবদুল হক ওয়াসেক গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার পেয়েছেন। হাক্কানি গ্রুপের অন্যতম সক্রিয় সদস্য মোল্লা তাজমীর জাওয়াদকে করা হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের উপ-প্রধান।

জঙ্গিবাদী ও মানব সভ্যতার জন্য বিপজ্জনকদের নিয়ে তৈরি সরকারে একজনও নারী সদস্য নেই। অথচ দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশই তালেবান সরকারের একপেশে মন্ত্রিসভা নিয়ে নীরব দর্শক। খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে, পশ্চিমা দুনিয়া, বিশেষ করে আমেরিকা তালেবানদের প্রতি এত কিছুর পরও আস্থাশীল। আমেরিকা মানুষকে বিশ্বাস করাতে চাইছে, তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। ইসলামাবাদ সন্ত্রাসীদের মদত জুগিয়েও গত দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল নিয়েছিল, পাকিস্তানেরই হাতের পুতুল তালেবানরাও এখন সেই পথে হাঁটছে। সব সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গড়ার মিথ্যা বিভ্রান্তি তৈরিতেও তালেবানদের মদত দিচ্ছে পাকিস্তান।

তালেবানদের কথা ও কাজের মধ্যে অনেক ফারাক। এটা অতীতেও প্রমাণিত। আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য ব্যস্ত আমেরিকা গোটা দুনিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, দু-দশকে তালেবানরা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তারা নাকি সকলকে নিয়েই সরকার গঠন করতে চায়। আগের মতো শরিয়তের নামে জনজীবনকে বিধ্বস্ত করার রাস্তা নাকি পরিত্যাগ করেছে তালেবান। কিন্তু আফগান জয়ের পর তালেবানরাই বুঝিয়ে দিচ্ছে দুদশকে তাদের মানসিকতায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই পরাজিত আফগান নাগরিকদের ওপর অত্যাচার থেকে শুরু করে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর আগের মতোই চলছে তালেবানি সন্ত্রাস।

তালেবানরা বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের মনোভাব কিছুতেই বদলাতে পারে না। সবাইকে নিয়ে জাতি গঠনের কোনও চিন্তাভাবনাই নেই তাদের। আসলে তালেবানের ইসলামিক আমিরাতে গণতন্ত্রের কোনও স্থান নেই। ইসলাম ধর্মের নামে হিংসাত্মক, অসহনশীল এবং আধুনিক সভ্যতার বিরোধী কাজকর্মই তাদের পছন্দ। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলেও আধুনিক চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাস নেই। পশ্চিমা দুনিয়ার অন্ধবিরোধী তালেবান। কিন্তু পশ্চিমা অস্ত্রের ঝলকানি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। টেলিভিশনকে তারা শুধু ধর্মীয় প্রচারের হাতিয়ার হিসেবেই দেখতে চায়। সামাজিক গণমাধ্যম তালেবানদের কাছে তাদের কথা প্রচারেরই শুধু হাতিয়ার মাত্র। ইসলাম ধর্মের নামে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকেই একমাত্র পথ বলে মনে করে। অন্য মতের কোনও গুরুত্ব নেই তাদের কাছে।

তাই আফগানিস্তানে মোটেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন হয়নি। সকলকে নিয়ে সরকার গঠনের বিভ্রম ছড়ানোর চেষ্টায় অবশ্য কোনও কার্পণ্য নেই। বাস্তব বলছে, এটা তালেবান ও হাক্কানি জঙ্গিদের সরকার। তালেবানরা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, নারী, সংখ্যালঘু বা অন্য রাজনৈতিক মতকে মোটেই আমল দিতে রাজি নয়। সম্মিলিত সরকার বলতে তালেবানরা দুই তাজিক ও এক উজবেক প্রতিনিধিকে মন্ত্রিসভায় রেখে বোঝাতে চেয়েছে এটা সবার সম্মিলিত অন্তর্বর্তী সরকার। নারীদের বাদ দিয়ে আজকের দিনে সম্মিলিত সরকার বাস্তবসম্মত নয়, সেটা মানতে নারাজ তালেবানরা। টেলিভিশন ভাষণে তাই তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সাফ জানিয়েছেন, শুধু সন্তান ধারণ ও পালন করাই নারীদের কাজ। বাইরের কাজ পুরুষরাই করবেন। শুধু তা-ই নয়, নারীর নির্দেশ কোনও পুরুষের নাকি পালন করা উচিত নয়। মুজাহিদের এই বক্তব্যই প্রমাণ করে তালেবানদের আগের মানসিকতা একদম বদলায়নি।

তালেবানরা নারীদের স্বাধীনতায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী নয়। তাই পশ্চিমা দুনিয়া নারীদের মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্বের দাবি তুললেও লাভ নেই। নারীদের অধিকার দেবে না তারা। তালেবান শাসনে নারীদের যাবতীয় স্বপ্ন ও অধিকার অধরাই থেকে যাবে। চাপে পড়ে দু-একজন নারীকে মন্ত্রিসভায় নিলেও মানসিকতার বদল সম্ভব নয়। নারীদের মতোই অন্যদের কাউকেই এই সরকারে নেবে না তালেবানরা। এমনিতেই পূর্বতন সরকারের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বা চিফ এক্সিকিউটিভ ডা. আব্দুল্লাহ আবদুল্লাহর মতো উচ্চপদস্থ নেতারা কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সরকারে থাকতে রাজি হবেন না। তাই অন্যদের কথা ভাবতে পারতো তালেবানরা। কিন্তু নিজেদের হাতেই ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর তালেবানরা কিছুতেই অন্যদের সঙ্গে রাখতে চায় না।

আসলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তালেবান নেতারা দুনিয়াকে বোকা বানাতে চাইছে। তারা বোঝাতে চাইছে বিশ বছর আগের সঙ্গে এখনকার তালেবানের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে তালেবান-১ ও তালেবান-২ সরকারের মধ্যে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জঙ্গি হামলার সময়কার তালেবান প্রধানকে মন্ত্রিসভার মাথায় বসিয়ে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসই তালেবানদের মূল কর্মসূচি। তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের কাছ থেকে তালেবানরা শিখে নিয়েছে আমেরিকার চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল। আমেরিকাকে তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারে অন্যদেরও ঠাঁই মিলবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজে দায়িত্ব নিয়ে সবার অন্তর্ভুক্তির বিভ্রম ছড়াচ্ছেন।

মনে রাখা দরকার, ১৯৯০ সালেও তালেবানরা শুধু নিজেদের অ্যাক্টিং বা ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দিয়েই সরকার চালিয়েছিল। এটাই তালেবান কৌশল। আন্তর্জাতিক দুনিয়া যদি তালেবানদের পরিবর্তন সত্যিই মাপতে চান তবে তার পদ্ধতি ও মাপকাঠি আগে ঠিক করা জরুরি। মানবিক বা অন্যান্য সাহায্য দানের আগে তালেবানদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করাটা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতপুষ্ট হাক্কানি নেটওয়ার্কের মতো সন্ত্রাসীরা রয়েছে তালেবানদের সঙ্গে। তাই আফগানিস্তানে পাঠানো আন্তর্জাতিক সাহায্য জঙ্গিবাদীদের হাত আরও শক্ত করার আশঙ্কা থাকছেই। এমনিতে তালেবান উত্থানে দক্ষিণ এশিয়ায় অশান্তির আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে গেছে। জঙ্গিবাদীরা আফগানিস্তানে ফের সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আফগান জনগণকে সাহায্য করা জরুরি হলেও তালেবানকে মদত দেওয়া চলবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদে লাগাম টানতে হলে তালেবানরা উৎসাহিত হতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া চলবে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ