X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন তৃণমূলে সন্ত্রাস-দুর্নীতি বাড়িয়েছে

আনিস আলমগীর
১২ অক্টোবর ২০২১, ১৪:৫৭আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২১, ১৯:০৯

আনিস আলমগীর স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল ভিত্তি হচ্ছে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হবেন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু এখন সব স্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে বলে, বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়র নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির রাজনৈতিক পরিচয় স্থানীয় সরকারে তার দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার এই সিদ্ধান্তে দেশের সমাজ ব্যবস্থা এখন ধ্বংসের পথে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার পরিণতিতে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতিতে কোনও সম্প্রীতি নেই, নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী পালনই হচ্ছে রাজনীতির মূলমন্ত্র। দলের জন্য, দেশের জন্য রাজনীতি একেবারেই হারিয়ে গেছে। তৃণমূলে সন্ত্রাস বেড়েছে ২০ গুণ। জনগণের এসব নির্বাচনে কোনও আগ্রহ নেই। দলীয় সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় নির্বাচন।

দলীয় ফোরামের কাউন্সিলর নির্বাচন–সেও এক বড় তামাশা। দলীয় তথাকথিত কাউন্সিলে সন্ত্রাসীদেরই প্রাধান্য। এমপিদের ইশারায়, অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে দলের কাউন্সিলররা তৃণমূলের প্রার্থী নাম দিয়ে দলীয় নমিনেশন চাওয়া লোকদের একটি তালিকা কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে। কেন্দ্র সেখান থেকে মন্দের ভালো প্রার্থীকে নমিনেশন দিচ্ছে। তৃণমূলের প্রার্থী নির্বাচনের এই ত্রুটির কারণে নিজ দলেরই জনপ্রিয় ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না। জনগণও ভোট দেওয়ার জন্য জনপ্রিয়, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী পাচ্ছেন না। ফলে রাজনৈতিক দলের তথাকথিত প্রার্থী চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত হয়ে সমাজকে করছেন বিভক্ত। গ্রাম পর্যায়ের জানাজাতেও এখন দলীয় ভিত্তিতে মানুষ যোগ দেয়।

১৮৭০ সালে ব্রিটিশের সময়ে ‘চৌকিদারি আইন’ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। বিভিন্ন প্রকার নাগরিক ও সরকারি সুবিধা আইনগত কাঠামোতে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি হয়েছিল। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের খুবই প্রাচীন স্তর। এর অনেক পরে পৌরসভা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন এসেছে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তৃণমূলের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং একান্ত নাগরিক সুবিধাবলি দেওয়া হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

স্থানীয় সরকারের কনসেপ্টই হচ্ছে, সামাজিকভাবে সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত ব্যক্তি হবেন এর প্রতিনিধি, সে কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নাগরিকদের চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনও ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তা অবান্তর, দরকার তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। হাল আমলে জন্মনিবন্ধন, উত্তরাধিকার সার্টিফিকেটসহ অনেক কিছু স্থানীয় চেয়ারম্যান দিয়ে আসছেন।

গ্রাম্য আদালতের প্রধানও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এখানেও প্রয়োজন রাজনীতি-নিরপেক্ষ ব্যক্তি। দলীয়ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিরপেক্ষ থাকবেন তার গ্যারান্টি নেই। স্থানীয় সরকারে রাজনীতি যুক্ত করার ফলে এর মূল ভিত্তিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিজের চরিত্র ঠিক নেই এমন চোর, সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে নাগরিকদের চারিত্রিক সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে। চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ থাকতেই হবে, যাতে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সুযোগ না পান। এখন পদে পদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির সুযোগ রয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, টেস্ট রিলিফ, দুর্যোগকালে ত্রাণের ব্যবস্থা, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও ইউনিয়ন পরিষদের। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর হয়েছে এর মাধ্যমে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহ করা বা সার-বীজ বিলি করার দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের। এসব কাজে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করার উদ্দেশ্যই ছিল যাতে নাগরিকরা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে চেয়ারম্যান বা মেম্বার দ্বারা বঞ্চনার শিকার না হয়।

বর্তমান চার হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদের সিংহভাগ চেয়ারম্যান একাধারে ইউনিয়ন বা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা, আবার ইউপি চেয়ারম্যানও। দল থেকে নির্বাচিত বলে দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে তার পক্ষে নিরপেক্ষভাবে সব নাগরিক সেবা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলার তদারকি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। ফিল্ডে মূল কাজটি করেন সংশ্লিষ্ট থানা প্রশাসন। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব এখানে গুরুত্বহীন নয়। আগের দিন বরং তারাই মূল কাজটি করতেন।

এখন কোনও রাজনৈতিক দলের ক্যাডার যদি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি ছিনতাইকারীকে, মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে থানায় তুলে দেবেন নাকি নিজেই তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে যাবেন, সেটি বড় প্রশ্ন। আবার থানার সঙ্গে যোগসাজশে অনেক জায়গায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নিজেই মাদক বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করছেন, এমন খবরও পত্রিকায় আসে। রাজনৈতিক দলের কথিত নেতা থাকাকালেও তাই করতেন এরা।

অনেক স্থানে বিশেষ করে শহরতলির আশপাশের চেয়ারম্যানদের প্রধান ব্যবসা এখন জমির দালালি, অন্যের জমি দখল করা, ভূমিদস্যুদের হয়ে কাজ করা। এ কাজে তাদের অস্ত্র রাজনৈতিক পরিচয়। তারা থানাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী সহযোগিতা করবেন! ফলে একবাক্যে বলা যায়, সাধারণ জনগণের কাছে নির্ভরযোগ্য জনপ্রশাসন ব্যবস্থাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে।

আইনগতভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনই শুধু রাজনৈতিকভাবে হওয়ার কথা, এর প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রশাসন ভেঙে পড়ায় এমপিকে এখন করতে হয় স্থানীয় প্রশাসনের কাজ। এদের সবার কাজ প্রদত্ত দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেউ আইনগত চ্যালেঞ্জ করলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন হুমকির মধ্যে পড়বে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানেই সরকারদলীয় সমর্থকদের অলিখিত বাড়তি সুবিধা। তারপরও আগে ইউপি নির্বাচনে লড়তেন সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক এবং তাদের মধ্য থেকে জনপ্রিয়তা, সরকারি দলের আনুকূল্য মিলিয়ে যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হতেন। কিন্তু আইনগত বাধা না থাকলেও দলমত নির্বিশেষে মানুষ যাদের ভালোবাসে এমন ভদ্রলোকরা এখন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। কারণ, তাদের জয়ী হওয়ার পথ অনেকটা রুদ্ধ এখন। দলীয় মনোনয়ন যারা পাবেন, তারাই নির্বাচিত হবেন—এটা এখন প্রতিষ্ঠিত।

সরকারদলীয় প্রার্থীদের বেলায় এটা আরও সত্য। আর সবকিছু উপেক্ষা করে কোনও জনপ্রিয় নাগরিক যদি দলীয় প্রতীকের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ার সাহস করেন, নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী না থাকলে নির্বাচনের আগে তাদের ওপর হামলা অবধারিত এবং নমিনেশন জমা দেওয়ার সুযোগ খুবই সামান্য। সবাই ধরে নিয়েছেন নির্বাচন মানেই দলীয় প্রতীক পাওয়া। আর এই প্রতীক পাওয়ার জন্য তাদের যে লড়াই করে আসতে হয় সেখানে জনগণকে তোয়াক্কা করার দরকারও নেই।

পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করেছি আমরা। বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলে সন্ত্রাস যে হারে বেড়েছে, স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যে হারে দুর্নীতি বেড়েছে, সমাজ ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, সমাজপতিরা যে বিলীন হয়ে গেছে এবং সন্ত্রাসী-অশিক্ষিতরা যে সমাজের নেতৃত্ব নিয়েছে,  সরকার এবং আমলাতন্ত্রের উচ্চ স্তরে বসা লোকরা কি এখনও তা টের পাচ্ছেন না?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ