X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে’

প্রভাষ আমিন
১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৬:১২আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৬:১২

প্রভাষ আমিন শিরোনাম দেখে কেউ কেউ একটু অবাক হতে পারেন। যে দুয়েকজন মানুষ আমার লেখা নিয়মিত পড়েন বা ফলো করেন তারা জানেন, আমি ক্রসফায়ারসহ সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। আমি সবসময় আইনের শাসন চাই, সুশাসন চাই, ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু আমার বা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যাবে আসবে না। যারা দেশ চালান, যারা আইন প্রণয়ন করেন, যারা আইন প্রয়োগ করেন, যারা বিচার করেন, বিচার কার্যকর করেন; তারা কী চান, সেটা হলো আসল কথা। 

বর্তমানে বাংলাদেশে যে স্টাইলে ক্রসফায়ার চলছে, তার শুরুটা হয়েছিল বিএনপি আমলে। ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে প্রথম ব্যাপক হারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। তখন অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানুষ মারা যেত ‘হার্ট অ্যাটাকে’। ২০০৪ সালে এলিট ফোর্স র‍্যাব গঠনের পর ক্রসফায়ারের মিথ্যা গল্প সাজিয়ে মানুষ হত্যা শুরু হয়। সেই একই গল্প এখনও চলছে। 

শুরুতে ক্রসফায়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পায়। কারণ, শুরুর দিকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাই ক্রসফায়ারের শিকার হয়। ক্রসফায়ারের দাবিতে মিছিল, ক্রসফায়ারের পর মিষ্টি বিতরণের খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ক্রসফায়ারের পক্ষে প্রবল জনমত থাকার পরও তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও ক্রসফায়ার বন্ধের অঙ্গীকার ছিল। এমনকি গতকালের (বুধবার) সংবাদ সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি এও বলেছেন, যারা বেআইনি কাজে জড়িত হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রধানমন্ত্রীর এমন সুস্পষ্ট অবস্থানের পরও ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। বিএনপি আমলে শুরু হয়েছে, ১/১১-এর সরকারের সময় চলেছে, বর্তমান সরকারের সময়ও চলছে।

ক্রসফায়ার নিয়ে সমালোচনা হলে ক্রসফায়ার কমে গুম বেড়ে যায়। খুব বেশি সমালোচনা হলে কিছু দিন হয়তো বন্ধ থাকে। যেমন, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন বা টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার পর কিছু দিন ক্রসফায়ার বন্ধ ছিল। এখন আবার ডালভাত হয়ে গেছে। শুরুর দিকে শুধু র‍্যাব ক্রসফায়ার করতো এবং মারাও পড়তো সন্ত্রাসীরা। এখন সেসবের বালাই নেই। পুলিশ তো ক্রসফায়ার করেই, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকাও আদায় করে। ক্রসফায়ার আসলে খুব সহজ কাজ। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে কাউকে হত্যা করা কঠিন কিছু নয়। অনুমতি পেলে আনসারও করতে পারবে। আর গল্প তো সাজানো থাকেই- আটক আসামিকে নিয়ে গভীর রাতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। বাধ্য হয়ে র‍্যাব বা পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। তাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শুধু হেফাজতে থাকা ব্যক্তিটিই।

ক্রসফায়ারের আভিধানিক ব্যাখ্যা হলো- দুইপক্ষের গোলাগুলির মাঝে কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়া। তাতে সন্ত্রাসী যেমন গুলিবিদ্ধ হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের নামে যা হয়, তা স্রেফ ঠান্ডা মাথায় খুন। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে তিনটি ঘটনা ঘটে– খুন, সেটা জায়েজ করার জন্য একটা বানোয়াট গল্প এবং হেফাজতে থাকা মানুষকে রক্ষা করতে না পারা। আগেই বলেছি, ক্রসফায়ার এখন ডালভাত; সন্ত্রাসী যেমন মারা যায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মারা যায়, সাধারণ মানুষও মারা যায়। কিন্তু একজন মানুষ সন্ত্রাসী হোক বা না হোক; কাউকে হত্যা করার অধিকার কারোই নেই। বিচারক বিচার করে রায় দেবেন, শাস্তি দেবেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, গ্রামে একজন আরেকজনকে হুমকি দেয়, ‘তুই বেশি বাইরা গেছস, তরে ক্রসে দিমু’।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর জানা গেছে, মানুষ মারতে খুনি ভাড়া করার দরকার নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সেটা করে দিতে পারে। 

সরকার প্রধানের এমন সুস্পষ্ট অবস্থানের পরও কেন ক্রসফায়ার বন্ধ হয় না? কারণ, তার চারপাশে এমন অনেকে আছেন, যারা বিশ্বাস করেন ক্রসফায়ারই একমাত্র সমাধান। গত সপ্তাহে মিরপুর এলাকার এমপি শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছেন, ‘অনেক সময় বিরোধী দলের নেতারা বলেন ক্রসফায়ার দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে।’ নিজের অবস্থানের পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘একজন সন্ত্রাসীর জন্য লাখ লাখ মানুষের রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। সেই সন্ত্রাসীর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। তাকে ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলা উচিত।’ যাদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ, সেই র‍্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাশে বসিয়ে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন। এখন র‍্যাবের সেই কর্মকর্তা যদি কালই একটি ক্রসফায়ার করেন, তার দায় কার হবে, র‍্যাবের নাকি শিল্প প্রতিমন্ত্রীর? 

শিল্প প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হলে সাংবাদিকরা তার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি আরও  স্পষ্ট করেন, ‘আমি বলেছি, যারা সমাজের লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে, যারা মদ-ইয়াবা নিয়ে ব্যবসা করে নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করছে, যারা চান্দাবাজি, টেন্ডারবাজি করছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করছে, লাখ লাখ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা হরণ করছে, আমি তাদের ক্রসফায়ার দেওয়ার কথা বলছি।’

একজন আইন প্রণেতা, যিনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন; তিনি যদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন; তাহলে আর ক্রসফায়ার বন্ধের আশা করে লাভ নেই। আমরা আশা বা দাবি কার কাছে করবো?

তবে কামাল মজুমদারই প্রথম নন। এর আগে সাভারের এমপি ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানও তালিকা করে ক্রসফায়ারে দিয়ে এলাকা শান্ত করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

এছাড়া সংসদেও ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি উঠেছিল। সরকারি ও বিরোধী দলের এমপিরা এই প্রশ্নে দারুণ একমত ছিলেন। ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। আর তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি রীতিমত ফতোয়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘এদের ক্রসফায়ার করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে, কোনো অসুবিধা হবে না।’ পরে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ক্রসফায়ারের পক্ষে বিশাল বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি তোফায়েল আহমেদের মতো প্রবীণ নেতাও ধর্ষকদের ক্রসফায়ারের দাবি সমর্থন করেছিলেন। 

এই যদি হয় সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়া মন্ত্রী আর এমপিদের মনোভাব, তাহলে আর ক্রসফায়ার বন্ধের দাবি না করে সুন্দরবনে গিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে আসা ভালো।

ক্রসফায়ারের পক্ষের যুক্তিগুলো আসলে অকাট্য। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষী না পাওয়া, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া, সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থার প্রতি তীব্র অনাস্থা থেকেই মানুষ ক্রসফায়ারে সমাধান খোঁজে। গত সপ্তাহে রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায় ক্রসফায়ারের পক্ষের যুক্তিকে আরও জোরালো করবে। পাঁচ বছর পর দেওয়া মামলায় পাঁচ আসামিই বেকসুর খালাস পেয়েছে। এখন অনেকেই বলছেন, এই আসামিদের যদি তখনই ক্রসফায়ারে দেওয়া হতো, তাহলে আর আদালতের এত সময় নষ্ট হতো না। এখন সমস্যা হলো, এক দেশে বিচারভুক্ত আর বিচারবহির্ভূত- দুই ধরনের ব্যবস্থা চলতে পারে না। একদিকে বিচার-অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থায় বছরের পর বছর বিচার চলার পর দেশজুড়ে আলোচিত ধর্ষণ মামলার আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, আর বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থায় তাদের চেয়ে শতগুণ কম অপরাধ করা একজন ছিঁচকে সন্ত্রাসীকে পুলিশ ধরে, তার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে, রাতেই অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গিয়ে তা কার্যকর করে ফেলে। এক দেশে দুই ব্যবস্থা চলতে পারে না। প্রত্যেকটি মানুষের জীবন মূল্যবান। বিনা বিচারে হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আইন প্রণেতাদের উচিত ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি না দিয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করা, আদালতের সংখ্যা বাড়ানো, বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো, মামলাজট কমিয়ে আনা, দ্রুত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। যাতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসে। আর কোনও মানুষকে যেন বিনা বিচারে প্রাণ দিতে না হয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ