X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

আন্দোলনের কারণ আমলে নেওয়া প্রয়োজন

জোবাইদা নাসরীন
২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৪৬আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৪৬
জোবাইদা নাসরীন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলনে। তবে শুরুটা ঠিক এরকম ছিল না অর্থাৎ উপাচার্যবিরোধী ছিল না হয়তো। কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা ধারণ করেছে বা যে এক দফা দাবিতে এসে ঠেকেছে তা হলো উপাচার্যের পদত্যাগ।

ঘটনাটি ১৩ জানুয়ারির। ঘটনাটি খুব ছোট না হলেও এ পর্যন্ত আসার খুব বেশি কারণ ছিল না। হলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সংশ্লিষ্টতা এবং নিজে হলে থাকার অভিজ্ঞতায় এতটুকু জানি যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ই বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আসে। কখনও কখনও সেটি হামাগুড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যন্ত যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানেই সেটির নিষ্পত্তি ঘটে। তবে হলকে কেন্দ্র করে এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তার সবচেয়ে কাছের অতীতের প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্যাহ চৌধুরী।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলেছিলেন সেই আবাসিক হলের কয়েকজন ছাত্রী। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়ায় সেখান থেকেই সেই প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ’ ছাত্রী। ঘটনায় ক্রমশ ডালপালা বাড়তে থাকে। সেই ডালপালায় আরও তুষের আগুন ছিটায় ছাত্রলীগের হামলা এবং পরের দিনের ঘটনা। শিক্ষার্থীরা পরের দিন আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ ডাকা হয় এবং পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক আহত হন। সেই দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার প্রায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত ২০০-৩০০ শিক্ষার্থীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে জালালাবাদ থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ।

প্রতিদিনই নতুন খবরের জন্ম দিচ্ছে সেই আন্দোলন। গত ১৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে সিন্ডিকেট ডেকে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু  শিক্ষার্থীরা সেই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এখন আন্দোলন মোটামুটি এক দফায় চলে এসেছে। আর তা হলো উপাচার্যের পদত্যাগ। তবে এই আন্দোলনের স্পিরিট শুধু যে সাস্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়, শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ জারি রেখেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে করোনার কারণে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। মেস ভাড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোনও ছাড় না দেওয়াসহ প্রশাসনের নানা সিদ্ধান্তে অনেক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের ওপর বিক্ষুব্ধ ছিল। ছাত্রীদের এই আন্দোলনে তাদের সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সহায়তা করেছে শুধু। এখন শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন করছেন।

আন্দোলনের বিভিন্ন দিনক্ষণে বিভিন্ন বিষয় যুক্ত হওয়াতে  আরও ক্ষোভ তৈরি হয়। ফাঁস হয় উপাচার্যের একটি আলাপ, যেখানে তিনি আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। সর্বশেষ যে উপকরণ যোগ হয়েছে সেটি হলো কয়েকজন শিক্ষকের প্রতিবাদ। অনেকেই আশা করেছিলেন তাঁরা হয়তো শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু জানা গেলো বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। এই শিক্ষকরা মূলত প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের দাবি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সম্পর্কে অশালীন কটূক্তি করেছে। সেখানেই থেমে নেই। থেকে থেকে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে খানাখন্দ। শিক্ষকদের সেই প্রতিবাদী কর্মসূচি থেকেও অসম্মান দেখানো হয়েছে চাষা-ভুষাদের প্রতি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর এই ধরনটি অনেকটাই পরিচিত। মোটামুটি সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আন্দোলন করলেই একই প্রক্রিয়ায় সেটি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে এই ধরনটির একটি মারাত্মক ফল আছে, সেটি যিনি উপাচার্যের অধীনে থাকেন তিনি তখন দেখতে পান না। আন্দোলনের শুরু যে ইস্যু থেকেই হোক না কেন, যদি সেই আন্দোলন দমাতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন এবং পুলিশকে ব্যবহার করা হয় তখন সেটি অবশ্যম্ভাবীভাবে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। অন্তত গত বিশ বছরে এটিই পরিলক্ষিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

এখন যদি আমরা বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগ দিয়ে কবে থেকে ছাত্র আন্দোলন দমাতে পুলিশের এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ব্যবহার শুরু হলো সেটি বের করার চেষ্টা করি তাহলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের উদাহরণ হবে আমাদের কাছে। সে সময় আমরা দেখেছি, পুলিশের পাশাপাশি নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা করে ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন ঠেকাতো।  কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্ব পার হয়ে আমরা তো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারায় প্রবেশ করেছি, তাও বছর তিরিশ পার হয়েছে। তাহলে এখনও কেন একই কায়দায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর তরিকাই আমাদের কাছে একমাত্র মন্ত্র হয়ে থাকবে? এর বাইরে কি প্রশাসনিকভাবে আর কোনও পথ খুঁজে পাওয়া যায় না? কারণ, এটি শিক্ষার্থীদের কাছে ভিন্নরকম মেসেজ দেয়। প্রশাসন তাদের ওপর হামলা করানোর চিন্তা করছে বা করছে এই ভাবনা কোনও শিক্ষার্থীকে স্বস্তি দেওয়ার কথা নয় নিঃসন্দেহে। কারণ, সবাই জানেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন না চাইলে কখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা মিছিলে হামলা করা বা সেটি দমন করবে না। আর প্রশাসনের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার অনেকটাই যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে। এই সংস্কৃতিও শিক্ষার্থীরা চায় না।

মানি, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যপন্থী এবং বিরোধী গ্রুপ থাকে। বিশেষ করে একজন উপাচার্য যখন দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান তখন এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। আর তখনই অনেকে নিজের গ্রুপের বাইরে আর কারও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন না। তাই সবসময় যে ভবিষ্যৎ ঝকঝকে দেখতে পান এমনটা হয়ে ওঠে না। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বেশিরভাগ সময়ই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে হালকা করার চেষ্টা করা হয়। সেগুলো আসলে খাল কেটে কুমির নয় শুধু, নিজের নাকের ওপর বিপদের মুলা ঝুলানোর মতোই হয়ে যায়।

সবচেয়ে যে ক্ষতিটা হয় বা হয়েছে, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্পর্কের অবনতি। একটি শিক্ষা ব্যবস্থার সৌন্দর্য হলো শিক্ষার যুক্ত সবার সঙ্গে সবার আস্থার, ভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক, ক্রমশ আমরা সেগুলো হারিয়ে ফেলছি। একে অপরকে দোষারোপ করছেন। আমরা ভুলে যাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শিক্ষা আন্দোলনেরই অংশ। তাই আমাদের কাজের জায়গা হবে এই আস্থার সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা। আন্দোলন দমানোর মডেলকে বাতিল করে আলোচনার সর্বোচ্চ পথ খোঁজা। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সময় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে চলে যায় তখন আলোচনার পথটাও অনেকটাই বন্ধ না হলেও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবার মননে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন থাকবে, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই তাই হয়। এটাই শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল মনের সৌকর্য। তাই সেটিকে কীভাবে আমলে নিয়ে সম্পর্কের ভিতটি আরও পাকাপোক্ত করা যায় সেই বিষয়েই আমাদের কাজ করতে হবে অনেক।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ও আ.লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন আইন উপদেষ্টা
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ও আ.লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন আইন উপদেষ্টা
‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি, বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি, বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ
সর্বশেষসর্বাধিক