X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’– ক্যানসার দিবসের মর্মবাণী

রেজা সেলিম
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০২আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০২

রেজা সেলিম প্রতি বছরের মতো এ বছরও ৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এই দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো ও এই প্রতিরোধযোগ্য অসুখ যেন তুলনামূলক কম মৃত্যুর জন্যে দায়ী হয় তার উপায় খুঁজতে সবাই মিলে কাজ করা। এ বছরের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ বা সেবা নিতে বা দিতে যেন কোনও দূরত্ব না থাকে।

ক্যানসার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ, যা কেবল ২০২০ সালেই প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দুনিয়াতে ছয়টি মৃত্যুর একটি হয় ক্যানসারে। সাধারণত স্তন, ফুসফুস, কোলনরেক্টাম এবং প্রোস্টেট ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ-ও বলছে, ক্যানসারে মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তামাক ব্যবহার, উচ্চ বডি মাস ইনডেক্স, অ্যালকোহল সেবন, কম ফল ও সবজি গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে হয়। এছাড়া মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) এবং হেপাটাইটিসের মতো ক্যানসার সৃষ্টিকারী সংক্রমণ, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ৩০ ভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রে দায়ী।

'ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ' ক্যাম্পেইনের এই বছরে বিশ্বজুড়ে ক্যানসারের যত্নে যেসব অসাম্য রয়েছে সেগুলো বুঝতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি এই অসাম্যগুলো ভালো করে বুঝতে পারি ও স্বীকার করে নিই, নিশ্চয়ই সেগুলো দূর করতে সবাই মিলে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবো। এর জন্যে আমাদের খোলা মনের ভাবনা অসুখ পরিস্থিতির যেকোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলেই এখন বিশ্বের নামিদামি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতিতে একটি বিষয় প্রমাণ হয়ে গেছে, বড় বড় কাঠামোভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা আর জনগণের সচেতন অনুশীলনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক বেশি দূরত্ব রয়ে গেছে। গত দুই বছরের ভয়াবহ অতিমারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর স্বাস্থ্য কাঠামো ভেঙে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে সম্প্রসারিত যন্ত্রমুখী স্বাস্থ্য বাণিজ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের অংশগ্রহণের অনীহাকেই এখন দায়ী করা হচ্ছে। তাই এই দূরত্ব মোচনে এখন আন্তর্জাতিক সচেতনতার ডাক পড়েছে।

গত এক দশকে আমরা নিজেদের উন্নয়নমুখী জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রমাণ করে দিয়েছি ও এই নিয়ে দুনিয়ার সব অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেটি হলো একটি ‘মানবিক বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা। সেরকম পটভূমিতে ক্যানসার দিবসে আমাদের যে তথ্যগুলো দেখা জরুরি-

ক্যানসারের যত্নে বৈষম্য অপচয় বাড়ায়। বেশি বয়সের অসুখ ভেবে ক্যানসারের প্রতি আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে। অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মতোই ক্যানসার যেকোনও বয়সে হতে পারে, তবে ৪০-এর নিচে এর সংখ্যা তুলনামূলক কম। আমাদের দেশে যেহেতু আমরা ক্যানসার নিবন্ধন করি না ফলে প্রকৃত তথ্য না জানা থাকলেও প্রায় প্রতিটি পরিবারে এই রোগকে আমরা ‘বোঝা’ হিসেবেই চিন্তা করি। আমাদের জানা থাকতে হবে, অসংক্রামক রোগের বিশেষ করে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি ফেইলিউরের প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ এখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ৩০ ভাগেরও বেশি মানুষের রয়েছে। যারা ক্যানসার আক্রান্ত তাদের উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা নিয়ে দেশে তেমন কোনও কাজ নেই। ফলে ‘দূরত্ব’ মোচনে আমাদের এসব ক্ষেত্রে সমন্বিত গবেষণা জরুরি। আমাদের আরও বুঝতে হবে কোভিড অতিমারিতে আমরা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি কিন্তু আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়েছে অসংক্রামক রোগের ‘কো-মরবিডিটি’, যেমন- ক্যানসার, ফুসফুসের অসুখ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগ বা যাদের মস্তিষ্কে স্ট্রোকের ইতিহাস রয়েছে।

আমাদের দেশে ক্যানসার চিকিৎসাকে ‘ফিয়ার মডেলে’ বা ভীতিকর অসুখ হিসেবে বিবেচনা করে রেখে দেওয়া হয়েছে। অথচ ক্যানসার ছাড়াও অন্য যেসব অসংক্রামক রোগ আছে, যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, কিডনি ইত্যাদি সব রোগই প্রতিরোধযোগ্য। অন্তত সব নাগরিকেরই ‘ব্যয় সাশ্রয়ী’ বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে একটি যথাযথ জাতীয় নীতি থাকা দরকার। যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত রাখা, সম্ভব হলে অসংক্রামক বহু রোগের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

২০৩০ সালে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার ৩.৪ অর্জন করতে হলেও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের একটি সমন্বিত ও কার্যকর জাতীয় নির্দেশনা থাকা দরকার।

খুলনা অঞ্চলে ‘আমাদের গ্রাম ক্যানসার প্রকল্পে’র ১২ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, স্তন ক্যানসারে সচেতনতা এখন অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের স্তনে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলেই খুব সচেতন হয়ে যান। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষায় তাদের এত বেশি খরচ করতে হয় যে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয়ত, ক্যানসার চিকিৎসায় ড্রাগ ট্রিটমেন্ট বা কেমোথেরাপি ছাড়াও আরও কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি সমন্বয় করে নিতে হয়। কেবল একটি মাধ্যমে ক্যানসারের চিকিৎসা হয় না কিন্তু চিকিৎসা সেবায় সমন্বয় না থাকায় আলাদা-আলাদা সেবার জন্যে এখানে ওখানে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। ফলে আর্থিক অসুবিধা ছাড়াও সেবার প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। যেমন, রেডিওথেরাপি একটি বড় সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কেবল খুলনা বিভাগে প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার ক্যানসার রোগী পাওয়া যাবে, যারা রেডিয়েশন থেরাপি নিতে পারতেন। কিন্তু পুরো খুলনা বিভাগে রেডিয়েশন থেরাপির একটি কেন্দ্রও নেই। এসব রোগীকে ঢাকায় আসতে হয়, যেখানে সরকারি হাসপাতালে অপেক্ষার সময় কমপক্ষে ২ মাস। বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই উচ্চ মূল্যে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে রেডিওথেরাপি নেওয়া সম্ভব হয় না। এই রোগীরা চিকিৎসা প্রক্রিয়া থেকে ড্রপআউট হন।

আমাদের দেশে ক্যানসার চিকিৎসাকে সামর্থ্যের আওতার মধ্যে রেখে চিকিৎসার সুযোগ আছে। এর জন্যে দরকার ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ক্যানসার গবেষণায় মনোযোগ দেওয়া; তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে অসংক্রামক রোগ নির্ণয় সেবাকে সম্পৃক্ত করে নেওয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবসম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকায় চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যানসার রোগীরা ব্যথা নিরাময়ে প্রয়োজনীয় প্রশমন সেবা বা প্যালিয়েটিভ কেয়ার পান না। তাছাড়া রোগীদের যখন প্রশমন সেবার প্রয়োজন হয়, তখন ব্যয় বহনের সামর্থ্যও থাকে না।

তাহলে আমরা কী করতে পারি? আমাদের জীবনাচরণে পরিবর্তনের জন্যে স্বাস্থ্য শিক্ষার পাশাপাশি স্থানীয়/আঞ্চলিক ডাটার ওপর ভিত্তি করে এমন কোনও উপায়ের নীতি আমাদের বের করে নিতে হবে, যেন আমরা সমাজের মধ্যে এই চিন্তা ছড়িয়ে দিতে পারি যে আমাদের একটি অন্যায্য পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা থেকে আমাদের ও আমাদের দেশকে ন্যায্য অর্জন ও তা ধরে রাখার জন্যে আমরা সবাই সহযোগিতা করতে পারি। একটি পরিবারের একজন সদস্য যখন ক্যানসার বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন তখন পরিবারের সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্যে প্রবল অর্থনৈতিক ও সামাজিক যুদ্ধে নিয়োজিত হন। নারীদের ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ অবর্ণনীয়। কিন্তু আমরা এই বিষয়টিকে জাতীয় পরিবারের সমস্যা হিসেবে দেখে সবাই মিলে যুদ্ধে জয়ী হতে পারি। যে অসুখ প্রতিরোধযোগ্য তাতে জয়ী হতে নিশ্চয়ই আমাদের অনেক খরচ করে নিঃস্বদের খাতায় নাম লেখাতে হবে না। আর আমাদের মা-বোনদেরও আমরা একটি অন্যায্য অসম্মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে পারি।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প।
ই-মেইলঃ [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ