X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জিপিএ-৫ জাতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৩২আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৩২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা পরিচিত-অপরিচিত যার সঙ্গেই কথা হয় সবার সন্তান বা স্বজনই এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এত জিপিএ-৫ পাওয়া কী তাক লাগানো ফলাফল নাকি কাটছাঁট করা পাঠ্যসূচিতে তিন বিষয়ে কম নম্বর পরীক্ষা নেওয়ার ম্যাজিক– সেটা বড় প্রশ্ন। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী।

এরা ভর্তি হবে কোথায়? স্বাভাবিকভাবে এত ভালো ফলাফল করার কারণে বড় অংশই চাইবে বুয়েট, মেডিক্যাল ও পুরনো বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। সমস্যা হলো, এ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম বর্ষে ভর্তিযোগ্য যত আসন আছে, এর প্রায় চারগুণ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বড় একটি অংশ হতাশায় পড়বে। জিপিএ-৫ ছাড়াও যারা পাস করেছে, তারা সবাই কোনও না কোনও সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজে ঠিকই ভর্তি হতে পারবে। প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষিত এত বড় জনসংখ্যা নিয়ে জাতি কী করবে।

কর্মক্ষেত্রে এত বড় বাজার আছে কিনা সে বিবেচনা না করেই লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামক কারখানায়। উচ্চশিক্ষার মানের অবনতি নিয়ে সতত উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। এমনকি ব্যক্তি খাতের বড় ছোট উদ্যোক্তারাও বলেন, তাদের প্রয়োজন যে মানবসম্পদ সেটা তারা পাচ্ছেন না। উচ্চ মাধ্যমিকে অতি উচ্চ নম্বর পেয়েও একটি যথাযথ বাক্য লিখতে পারে না – এমন কথা শোনা যায় প্রায় সর্বত্র।

এর অর্থ হলো আমরা শিক্ষাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছি, যা মূলত ফলাফল কেন্দ্রিক, বাস্তব জ্ঞান কেন্দ্রিক নয়। এতে উচ্চশিক্ষার যে সর্বনাশ হচ্ছে, এ বিষয়ে এখন প্রায় নিঃসন্দেহ প্রায় সবাই। অনেকেই ভর্তি পরীক্ষায় অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার প্রবেশপথে আরও শক্ত দেয়াল তোলার পক্ষে, যাতে যেনতেনভাবে সুযোগ পাওয়া না যায়। সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বেশি। তবু উদ্যোক্তারা যখন বলেন কাজের উপযোগী লোক তারা পান না তখন ভাবা দরকার পুরো সিস্টেম নিয়েই।

আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রায় ৫০টি। আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শত শত কলেজ, যারা উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি দিচ্ছে। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে গুণমানের একটা সম্পর্ক আছে সেটা বোধহয় আমরা ভাবতেও চাই না। বেশি সংখ্যক মানুষ উচ্চশিক্ষায় এলে শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বাড়ে, তার বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশ। দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি উৎসে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রায় সবার চাওয়া একটি সরকারি চাকরি। এবং সে জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। অনেকে একাধিক বিসিএস এবং সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেয়। নিদেন পক্ষে একটা কেরানির চাকরি হলেও সরকারি চাকরি প্রিয় সবার কাছে। না পেয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। যে পরিমাণ প্রত্যাশী তার তুলনায় সরকারি চাকরি নেই।

বিআইডিএস’র এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশের মতো। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যদি এরকম হয় তাহলে এত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস দিয়ে জাতির কী উপকার হচ্ছে? উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সংকট। শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার সামনে আরও বেশি দেখার আশঙ্কা আছে। কারণ, এই শিক্ষিতদের এমনিতেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমাদের হাতে গোনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিদের মান ভালো না। করোনায় সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানের অধোগতি তো আছেই, সঙ্গে আছে প্রয়োজনটাও। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পরপরই যদি বড় একটা অংশকে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা যেত, তার ফলাফল বেশি পেতে পারতো জাতি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে ফেললাম। শিক্ষা নিয়ে কত কথাই না হচ্ছে। উন্নয়নের কত গল্পই না বলছি। কিন্তু বুনিয়াদি শিক্ষা ও তার মান, সমাজের সর্বস্তরের শিশুদের যথার্থ গুণসম্পন্ন বিদ্যালয় শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি ও সুযোগের সাম্য, সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের সাম্য বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, এ সব বাদ দিয়ে উচ্চশিক্ষার আলোচনা হয় না। দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ হয় বিদ্যালয় বা কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারছে না, বা পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা মান ছুঁতে পারছে না। এই ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা মানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যা প্রয়োজন, তার দিকেও রাষ্ট্রের নজর আসেনি এই ৫০ বছরে।

উচ্চশিক্ষায় বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তির প্রয়াস নেই, নেই মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা। আছে কেবল বেসরকারি খাতে শিক্ষা বাণিজ্য আর সরকারি খাতে শিক্ষা রাজনীতি। একদিকে শিক্ষার উচ্চাঙ্গনে প্রবেশের ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা এবং চাপ, অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষিতদের ব্যাপক বেকারত্ব – এমন এক অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা প্রয়োজন আমাদের।

 

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ