X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়

মনিরা নাজমী জাহান
০৮ মার্চ ২০২২, ১৪:৩৩আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ২১:০৬

মনিরা নাজমী জাহান ভাবতেই আনন্দ লাগে যে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আলাদা করে নারীদের জন্যই শুধু একটা দিন। সেই দিনটি হচ্ছে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারীর আত্মত্যাগের এক গৌরবগাথা।

প্রথম ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আমেরিকায় নারী দিবস (National Women's Day) উদযাপন করা হয়েছিল। সোশালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা নিউ ইয়র্কে ১৯০৮ সালে পোশাক শ্রমিকরা তাদের কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট শুরু করেন। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ আর সমমানের বেতনের দাবিতে চলে ধর্মঘট। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে  জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগলো। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ দিনটিকে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রদের নারী অধিকার ও বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য জাতিসংঘ দিবস হিসাবে ৮ মার্চকে ঘোষণা করার আহ্বান জানায়। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়।

বাংলাদেশেও ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সব পর্যায়েই এই নারী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশে  নারীদের সম্মানে এই নারী দিবস পালিত হয় সেই বাংলাদেশের নারীরা কেমন আছে? আসুন দেখি পরিসংখ্যান কী বলে–

মহিলা পরিষদের  তথ্য বলছে, বিদায়ী বছরটিতে ৬২৯টি কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ১৮ জন। এছাড়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২টি কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন। ২২টি কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। এছাড়াও ৯৩টি কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২১ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার যেমন হয়েছেন, তেমনি নানা কারণে আত্মহত্যাও করেছেন অনেকেই। এর মধ্যে অনেকেই উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

গত বছরের তথ্য বলছে, বিভিন্ন কারণে ১১৪টি কন্যাশিশুসহ ৪৪৪ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি ৫১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন ১২ জন। এছাড়া ২০২১ সালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমবেশি একইরকম ছিল। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ৪১ জন, মার্চে ৪৯ জন, এপ্রিলে ৪০ জন, মে মাসে ৪১ জন, জুনে ৩৮ জন, জুলাইয়ে ২৮ জন, আগস্টে ৩০ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৩ জন, নভেম্বরে ৩৯ জন ও ডিসেম্বরে ৩২ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ১৯টি কন্যাশিশুসহ ৮৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও ১৩১টি কন্যাশিশুসহ ৪২৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে গত বছর। একই সময়ে ৫৮টি কন্যাশিশুসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। ৩২টি কন্যাশিশুসহ ৪৬ জনকে উত্ত্যক্ত করার তথ্য মিলেছে। এরমধ্যে একটি কন্যাশিশুসহ উত্ত্যক্ত হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুই জন। এছাড়া ৪৩টি কন্যাশিশুসহ ১২১ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে গত বছরে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার ঘটনা ঘটেছে চারটি। পাঁচটি কন্যাশিশুসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ১১ জন।

২০২১ সালে বাল্যবিয়ের ঘটনা উদ্বেগ ছড়িয়েছে। ২০২০ সালে ১১৭টি বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া গেলেও বিদায়ী বছরে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৩২৭টি। এরমধ্যে মাত্র ৪৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেছে। ১৩ টি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে ১৮৫টি। এরপরই নভেম্বর মাসে ৭৪টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে ১০টি, মার্চে পাঁচটি, এপ্রিলে দুটি, মে মাসে একটি, জুলাই মাসে দুটি ও অক্টোবরে একটি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জুন, আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসে কোনও বাল্যবিয়ের ঘটনা কোনও পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি।

মহিলা পরিষদের প্রদত্ত তথ্য বলছে, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর কেবল কিশোরগঞ্জ জেলাতেই ২৬০ মাদ্রাসাছাত্রীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত দেড় বছরে কেবল টাঙ্গাইল জেলাতেই ১ হাজার ২৪২টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। বাল্যবিয়ের পাশাপাশি যৌতুক গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত নির্যাতনের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। একটি কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। এরমধ্যে ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। লকডাউন ও করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও থেমে ছিল না অপহরণ ও পাচার। ১৫৩টি কন্যাশিশুসহ এ বছর অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৮০ জন। এছাড়াও আটটি কন্যাশিশুসহ ১১ জনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। ছয়টি কন্যাশিশুসহ ৪২ জন নারী ও কন্যাশিশু পাচারের শিকার হয়েছেন। মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে পাঁচটি কন্যাশিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে এসিডদগ্ধ হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন তিনটি কন্যাশিশুসহ ২৩ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১০ জন।

এবার আসুন তাকাই একটু আইন অঙ্গনের তথ্য-উপাত্তের দিকে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি থেকে বলা হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে শুধু নারী ও শিশু সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা আনুমানিক ১৯ হাজার।

প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে এই কথা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের নারীদের এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়।  বাংলাদেশের নারীদের  নির্যাতন এবং নিপীড়নের এক অদৃশ্য আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। বাংলাদেশের ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি জায়গার মধ্যে এমন এক ইঞ্চি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে একজন নারী নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে। যাপিত জীবনে এমন একটি সম্পর্ক পাওয়া যাবে না যে সম্পর্কের কাছে নারী নিরাপদ।

পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থা শুধু নারীকে নির্যাতন কিংবা নিপীড়ন করেই থেমে থাকে না। এই নির্যাতনকে কীভাবে জায়েজ করা যায়, কীভাবে একজন নির্যাতনকারীকে  বীরোচিতভাবে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে প্রচেষ্টা চলে অবিরাম। নির্যাতনের শিকার নারীর চরিত্রে কালিমা লেপনের এক কুৎসিত আনন্দে মেতে ওঠে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।  

নারী দিবস পালনে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই কিন্তু সব আগ্রহ ভাটা পড়ে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নারীবান্ধবের উদ্যোগ নিতে বলা হয়। আমরা নারী দিবসের অনুষ্ঠান পালন করার ক্ষেত্রে যে উৎসাহ দেখাই তার কিয়দংশ উৎসাহও দেখাই না রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে। আমরা নারীর উন্নয়নের বিষয়ে বুলিসর্বস্ব হতে ভালোবাসি। আমাদের দেশের নারীর উন্নয়ন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে তাত্ত্বিক বুলি আওড়ানোতে সীমাবদ্ধ। নারীর উন্নয়নের সঙ্গে যে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত সেটি নিয়ে চিন্তা করার মতো সময় কারও নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে ভালোবাসে।

তাই নারী দিবস শুধু অনুষ্ঠান পালন কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতির  মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। নারী দিবস পালনের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ব্যক্তিকে নারীর অধিকার ও লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও তার প্রাপ্য অধিকারের লড়াই জোরদার করতে হবে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র প্রতিটি পর্যায় থেকেই নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দাবি ডিআরইউর
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দাবি ডিআরইউর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ