X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরেক বাবর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৯ মার্চ ২০২২, ১৭:১০আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২২, ১৭:১০
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ‘চিরদিন কারও সমান নাহি যায়’। যেমনটা যায়নি জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের এবং এখন যাচ্ছে না সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের। গত সোমবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হন ফরিদপুরের ত্রাস এই বাবর।

একসময়ের ছোট মুরগি ব্যবসায়ী বাবরের এখন অঢেল ধনসম্পদ। পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। একসময়ের জেলা বিএনপি নেতাদের পাশে ঘুর ঘুর করা বাবর তার ভাইয়ের দাপটে হয়েছিলেন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। হয়েছিলেন সদর উপজেলার চেয়ারম্যানও। আজ হাওয়া বদলে গেছে। তাই সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের হাতে এখন হাতকড়া। মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। যে মামলায় বাবর গ্রেফতার হয়েছেন, তাতে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলও আসামি। দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও পাচারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়। পরে সেই মামলার তদন্তে বাবরসহ আরও আট জনের নাম উঠে আসে।

ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে এমন কী জাদু আছে যে রাতারাতি একটা জেলা পর্যায়ের নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যেতে পারেন? এই রাজনীতি কী বদলে দিচ্ছে চিরাচরিত সংস্কৃতি আর সহজ-সরল জীবনবোধ? ফরিদপুরের বাবর, সাজ্জাদ বা রুবেল, ঢাকার ইসমাইল হোসেন সম্রাট, এনু-রুপম, খালেদরা বুঝিয়ে দিয়েছে রাজনীতির আদর্শহীনতা কত বড় টাকার খনি!

জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা রোজ বদলে দিচ্ছেন এসব নেতা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্ম হচ্ছে। অবশ্যই সেই ব্যক্তি খন্দকার মোশারফের মতো প্রভাবশালী এবং অর্থ আর পেশিশক্তিই তাদের মূলধন। দখল, লুণ্ঠন, দলের ভেতর পদ-বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্যসহ এমন কোনও কাজ নেই যা তারা করেন না। জীবনবোধের মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন। আগামী প্রজন্ম এসব দেখেই বড় হচ্ছে। শিশুর অবচেতন মনে এসব আদর্শহীনতা গেঁথে যাচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি, ‘আলুটা-মুলোটা’র লোভনীয় টোপ, যা পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রমিত হচ্ছে। কিন্তু লাগাম টানার সিস্টেম নেই। একটা দুইটা গ্রেফতার ঘটনা ঘটে, যেমন বাবরেরটা ঘটলো, কিন্তু ব্যাপক আকারে বিরাজমান হত্যা, খুন, সহিংসতা আর দুর্নীতির নষ্ট রাজনীতি।

মন্ত্রী ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা শক্তিশালী মানুষ। তার ভাই আরও মাত্রাছাড়া দুর্বৃত্ত। তার কারণে ফরিদপুরের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দল করতে পারেননি। নানা সময় নির্যাতিতও হয়েছেন। তাদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার। এই চিত্র সারা দেশের। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগের ভেতর কোন্দল, বিবাদ আর বিদ্বেষ কী পরিমাণে আছে।

শীর্ষ নেতৃত্বের চোখরাঙানি দেখি আমরা মাঝে মাঝে। কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে দলের একাংশ সব অন্যায় করে চলেছেন। এভাবে যে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয় সেই ভাবনাটা নেই। চাঁদাবাজি আর আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি চলছে এবং অসন্তোষটা তৃণমূল স্তর পর্যন্তই ছড়িয়েছে বলেই আমরা দেখছি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের নিচের তলায় যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি হচ্ছে, তার ফয়দা নিচ্ছে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। দলের নেতার দুর্নীতি নিয়ে সরব এখন দলেরই লোকজন।

মূল প্রশ্ন নৈতিকতার। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির তাগিদে যখন প্রার্থী-বাছাই পর্বে পেশিশক্তি কিংবা দাগি দুষ্কৃতিদের টিকিট বিতরণ করে, তখনই তো তাদের অগ্রাধিকার নির্ণীত হয়ে যায়। বোঝা যায়, সেই অগ্রাধিকারের তালিকায় রাজনৈতিক নৈতিকতার কোনও স্থান নেই, আছে কেবল সুবিধাবাদের। ব্যক্তি-রাজনীতিকের লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে দল ও সংগঠনের তরফে নৈতিকতা বিসর্জনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুশীলনের বেপরোয়া মনোভাবেই বাবররা তৈরি হয়।

খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেফতারের ঘটনায় ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। এবং এটা করেছেন দলের নেতাকর্মীরাই। কারণ, ২০১০ সাল থেকে বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ক্ষমতা ব্যবহার করে ফরিদপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের সবাইকে তার আনুগত্যে আনতে বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি। আজ সেই অত্যাচারিত নেতাকর্মীরা তার গ্রেফতারে আনন্দ করছেন। তারা একসময় নীরবে সয়েছেন সব যন্ত্রণা।

রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি ঠিক না হলে কোনও কিছুই ঠিক হবে না। রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিশুদ্ধ হবে না। এমনকি শিক্ষাঙ্গনের অরাজকতাও দূর হবে না।

রাজনীতিকরাই বলছেন, রাজনীতি এখন রাজনীতিকদের কাছে নেই। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক, পেশিধরদের দখলে চলে গেছে রাজনীতি। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু সমাধান আর হয় না।

রাজনৈতিক দলের ভেতর এই বড় ভাইগিরি ভয়ংকর। মাথার ওপর যেহেতু নেতার আশীর্বাদের হাত আছে, ফলে যা ইচ্ছে তা করার লাইসেন্স পায় বাবরদের মতো হাইব্রিডরা। ফলাফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। লোকের বুকে পা তুলে, দখল করে সম্পদশালীর হওয়ার রাজনীতি পথেঘাটে বাবর সৃষ্টি করছে।

লেখক: সাংবাদিক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ