X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা বোধহীন, তাই গেস্টরুমে নিপীড়ন ‘নেই’ বলি

জোবাইদা নাসরীন
১৯ মার্চ ২০২২, ১৫:৫২আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২২, ১৫:৫২
জোবাইদা নাসরীন সকাল আটটায় ক্লাস দিয়েছিলাম সেদিন। ক্লাসটি ফার্স্ট ইয়ারের সঙ্গে। প্রথম বয়সের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেভাবে সরাসরি ক্লাস নেওয়া হয়নি। দু’ই একটি ক্লাস নেওয়ার পরেই আবার করোনার জন্য সশরীরে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর যখন আবার গত মাস থেকে সশরীরে ক্লাস শুরু হলো তখন ভাবলাম একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ক্লাস নেবো। তো সেখানে একজন ছেলে শিক্ষার্থী বারবার হাই তুলছে। ভাবলাম সকালে ক্লাস হচ্ছে বলেই তার ঘুম ভাব এখনও যায়নি। কিন্তু একটু পরই আরেকজন শিক্ষার্থী সেই শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ করেই বললো, ‘কেমন হইলো কাল রাতের ছবি তোলা মামা?’ আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম তার খারাপ লাগছে কিনা? তখন সে বললো, ‘আসলে ম্যাম রাত বারোটায় হলের গেস্টরুমের কাজ শেষে করে বড় ভাইয়েরা আবার পাঠিয়েছিল সুফিয়া কামাল হলের পাশ থেকে ছবি তুলে আনতে। সেখান থেকে ফিরেছি দুইটার পর। তারপর মিছিল ছিল। সেখানে তো যেতেই হবে। তারপর আর ঘুমাতে পারিনি। তাই একটু খারাপ লাগছে। ‘আমি জিজ্ঞেস করলাম,  ‘গেস্ট রুমে কী কাজ তোমার?’ ছেলেটি যেন অনেকটাই চমকে উঠলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন ধরে আছি কিন্তু হলের গেস্টরুমে ওর মতো ছেলেদের কী কাজ থাকতো পারে সেটাই আমি জানি না? ছেলেটি দ্বিধা কাটিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো ‘সত্যি আপনি জানেন না কী হয় গেস্ট রুমে?’

আমি হয়তো জানি, কিন্তু সবটাই জানি এমন দাবি করতে পারবো না। আর সবার অভিজ্ঞতা সমান নয়। আমি তার থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম। তাই আমি আরও দৃঢ়তার সাথে ‘না’ বললাম। ছেলেটি জানালো তাকে প্রতিদিনই এই ‘গেস্টরুম’-এ কাজ করতে হয়। রাত দশটায় তার মতো অনেক প্রথম বর্ষের ছাত্রকেই ডাকা হয়। হলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আগের বর্ষের শিক্ষার্থীরা ‘ম্যানার’ শিখায়। সেই ‘ম্যানারের’ মধ্যে আছে ভাইদের দেখলে সালাম দেওয়া, তবে সেই সালাম সব জায়গা দেওয়া যাবে না। জায়গা বুঝে দিতে হবে। ‘ভাই’রা কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে। সেখানে হলের অতিথি কক্ষের সোফাগুলোতে বসেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে সেখানে আগের দিনের ঘটনার পোস্টমর্টেম করা হয়। ৫-১০ জন প্রতিদিনই কোনও না কোনও ধরনের শারীরিক হেনস্তার শিকার হয়। তাদের অপরাধ ‘বড় ভাই’ সামনে থাকা সত্ত্বেও তারা দেখেনি এবং সালাম দেয়নি। তাদের দলের মিছিলে যেতে চাপ দেওয়া হয়। এই গেস্টরুমের বিষয় চলে ঘণ্টা খানেক কিংবা সময় সময় আরও বেশি। এরপরেই যে শেষ তা নয়। তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ছবি তুলতে। এরমধ্যে মেয়েদের হলগুলোর আশপাশে পাঠানো হয় সবচেয়ে বেশি। এবং সেগুলো বড় ভাইদের দিতে হয়, দেখাতে হয়। তারপরও শেষ নেই। মধ্যরাতে করতে হয় মিছিল। না গেলে পরের দিন শাস্তি অনিবার্য। কে এলো না, কেন এলো না সেগুলো নজরদারিরও লোক আছে। ঘুমানোর সময় নেই, পড়ার সময় নেই।

ছেলেটি আরও জানায়, প্রথম প্রথম সে খুবই মানসিকভাবে আক্রান্ত বোধ করতো। জ্বর এসেছে, করোনা হতে পারে– এই বলে এই অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে হলে ওঠার  প্রথম মাসেই ১ মাসের জন্য বাড়ি চলে গিয়েছিল। তবু মুক্তি মেলেনি। এখন এটাকে মেনে নিয়েই চলছে জীবন। কাউকে বলতে পারে না। কাউকে বললেই আরও বিপদ। কখনও কখনও মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবে। সেটিরও উপায় নেই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে আবারও চলে আসে।

এটি যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের চিত্রই শুধু তা নয়, এটি প্রত্যেকটি ছেলেদের হলের চিত্রই হয়তো।

এই ক্লাসের দুদিন পর আমি আরও দুই জন ছাত্রের ইমেইল পাই। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কারণ এই গেস্টরুম সংস্কৃতি। তারা অন্য দুই হলের। তারা একটু শান্তি চায়, স্বস্তিতে শিক্ষাজীবন শেষ করতে চায়।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবর আলোড়ন তুলছে। হয়তো সবার মনে নয়, আমার মনেই হয়তো। খবরটি ছিল এই রকম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি মেনে না নিতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছেড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়া মোহাম্মদ আলী রানা। ঢাবি ছেড়ে রানা সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, রানা জানিয়েছে নিজের বাড়িতে থেকেই টিউশনি করে তিনি লেখাপড়া করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন না।

আহা, স্বপ্ন, সাধ, লক্ষ্য সবই পাল্টে যায় একটি দাপটের কারণে, আমাদের অবহেলার কারণে, আমাদের ক্ষমতার সঙ্গে লেগে থাকার মনস্কতার কারণে। কী অপরাধ এই শিক্ষার্থীদের। বারবার এই ‘গণরুম’ আলোচনায়  এলেও কেন এখনও এইভাবে এটি চর্চিত হচ্ছে। হল প্রশাসন জানেন না এটি এমনও নয়, অবশ্যই জানেন, কিন্তু উদ্যোগ নেই এটি থামানোর। কারণ তো সবারই জানা। কারা করছেন, কেন করছেন সবাই জানে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায় এবং দায়িত্ব সব কিছুই হারিয়ে যায় ক্ষমতার কাছে। আর এগুলোকে আমলে না নিয়ে, জারি রেখেই আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির কথা ভাবি।

আমার ক্লাসের সেই শিক্ষার্থীর অসহায় মুখটি আমার সামনে বারবার ভাসতে থাকে। আর মনে হয় তার আকুতি, আমি ঘুমাবো কখন, পড়বো কখন?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ