X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকের বাহানায় নারীকে নিয়ন্ত্রণ

জোবাইদা নাসরীন
২২ মে ২০২২, ১৯:১৮আপডেট : ২২ মে ২০২২, ১৯:১৮

না, নরসিংদীর ঘটনা পৃথক কোনও ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিদিনই আমি-আপনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখনই আপনার-আমার পাশে হাঁটতে থাকা অনেক মানুষ বিড়-বিড় করে অনেক কিছু বলতে থাকেন। আমি যখন হেঁটে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, আমার সবচেয়ে বেশি শোনা কথাগুলো হলো, ‘বুকের ওড়না ঠিক কইরা চলাফেরা করেন, মাথায় কাপড় দেন, বাজারে কাপড়ের অভাব নাকি, ফুলহাতা জামা পরা যায় না?’ এগুলো যে শুধু পুরুষরা বলছে তা কিন্তু নয়, বলছেন অনেক নারীও। কারণ, নারীরা সমাজের পাখি, তারা পুরুষের বুলি আওড়ান।

আপনি যদি এর উত্তরে কারও দিকে ফিরে তাকান, কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন, দেখতে পাবেন তখন অনেকে দ্রুত হাঁটা শুরু করেন, অনেকে উল্টো চোখ রাঙায়, আবার অনেকেই, ‘দেশে গজব পড়ছে’ টাইপ বক্তব্য দিতে শুরু করে। তাই নরসিংদীর ঘটনাতে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া নরসিংদীর রেল স্টেশনে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনার ভিডিওতে দেখা গিয়েছে যে  সেখানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা এক নারী জিন্স ও টপস পরেছেন। সেটি সম্পর্কে এক ব্যক্তি সেই মেয়েটির সঙ্গে থাকা দুই তরুণকে প্রশ্ন করছেন? স্টেশনে উপস্থিত অনেক নারীও তৎপর ছিলেন মেয়েটিকে হেনস্তা করতে। এ ধরনের প্রশ্নের মানে হলো সেই তরুণরা কীভাবে একজন তরুণীর জিন্সের প্যান্ট এবং শার্ট পরাকে মেনে নিচ্ছেন?

শুধু নোংরা মন্তব্যের মধ্য দিয়েই সেটি শেষ হয়নি। এ সময় স্টেশনে থাকা সাধারণ মানুষও জড়িয়ে যান তর্কে। ভিডিওতে দেখা যায় অনেকেই উত্তেজিত হয়ে বলছেন, ‘এ ধরনের পোশাক পরলো কেন?’ তৈরি হয় বেশ জটলা। দফায় দফায় তর্ক চলতে থাকে। তারপর ভিডিও’র সূত্র অনুযায়ী লাল টি-শার্ট পরা একজন এগিয়ে গিয়ে সেই মেয়েটিকে আক্রমণ করে এবং জীবন বাঁচাতে মেয়েটি দৌড়ে স্টেশন মাস্টারের রুমে ঢুকে।

এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর কমেন্ট বক্সে এর পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা ধরনের হাজার হাজার মন্তব্য আসে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই নারীবিদ্বেষী এবং নারী কেমন পোশাক পরবে সেই বিষয়ে উপদেশমূলক।

তবে নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে এই প্রথম নয় বরং কয়দিন পরপরই বাংলাদেশে পোশাকের কারণে নারীদের হেনস্তা করার খবরও আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। বিশেষ করে ধর্ষণের মতো সহিংস ঘটনাতেও  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীকে উল্টো তার পোশাকের জন্য দায়ী করার প্রবণতাও দেখা যায়। বাংলাদেশে কি আগেও এমনই হতো? ইতিহাস কী বলে?

এ দেশে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও গ্রামে অনেক নারী ব্লাউজ কিংবা পেটিকোট পরতেন না। এটিই স্বাভাবিক ছিল। তখন কিন্তু নারীর পোশাক  নিয়ে কোনও কথাই তো শোনা যায়নি। তাহলে এখন কেন হচ্ছে? এর কারণ কী? কেনই বা এই সময় এসে নারীর পোশাক নিয়ে এত হৈ চৈ হয়? পোশাক নির্বাচন কি তবে কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় নয়?

একজন মানুষ কী ধরনের পোশাক পরবে সেটি নির্ভর করবে তার নিজস্ব রুচি, অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর। এমনকি লক্ষ করবেন ছোট বাচ্চারা পোশাক নির্বাচনে নিজেদের পছন্দ এবং ভালো লাগাকে গুরুত্ব দেয়। এটিই প্রথম তার নিজস্ব স্বাধীন পছন্দ তৈরি হওয়ার ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে।

যখন কারও বিশেষ করে পোশাক নিয়ে অন্যরা কথা বলে তার মানে প্রথমত হলো নারীর পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতার ওপরই আঘাত করা। কারণ, এটি নারীর পছন্দের হবে কেন? পুরুষই নারীর পা থেকে মাথা পছন্দ সবকিছু ঠিক করে দেবে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুরুষের হাতে।  নারীর জন্য পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেনে নিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পোশাকের আবরণের মধ্য দিয়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার যে ধারণা সেটিও কিন্তু এর সঙ্গে কাজ করছে। আগে কেন কথা হয়নি, কেন এখন হচ্ছে এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, আগে হয়তো নারীরা পুরুষের অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন সেটি ভেঙে নিজের একটা পরিসর তৈরি করছে। এটি সমাজ দেখতে এখনও অভ্যস্ত হননি। শুধু রাস্তাঘাটেই নয়, আমার স্বয়ং দর্জিই যখন আমার জামার গলা, পিঠের মাপ নিয়ে উপদেশ দেন তখন শঙ্কাগুলো আরও বেড়ে যায়। কারণ, আমার দেহকে নিয়ন্ত্রণ সবাই করতে চায়, আর সেটি পোশাকের আবরণে।

শুধু পাবলিক পরিসরেই কেন, ঘরেও অনেককেই বলতে শুনি ‘আমার স্বামী পছন্দ করেন না আমি এই ধরনের পোশাক পরি, তাই ভালো লাগলেও পছন্দর পোশাক পরতে পারি না’। পোশাক নিয়ে পাবলিক পরিসরে সহিংস ঘটনা ঘটলে আমরা সেটি নিয়ে মনোযোগী হই, কিন্তু হয়তো আমাদের বেশিরভাগ ঘরেই নারীই তার পছন্দের পোশাকটি পরতে পারে না। এই না পরার কারণ হয়তো প্রিয়জনকে খুশি রাখা, কিন্তু এটির মধ্য দিয়ে যে ঘর এবং বাইরে, উভয় পরিসরে নারীরা কখনও প্রিয়জনদের খুশি করতে, কখনও সমাজকে খুশি করতে আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছেন তার নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাটুকুও। স্বাধীনতার কথা বাদেই দিলাম।

তাই পোশাক নিয়ে তুমুল কাণ্ড কিংবা একটি টিপ নিয়ে এত মাথাব্যথার কী আছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে এভাবে প্রশ্ন না ছুড়ে চিন্তা করতে থাকুন, আপনি নিজেই সমর্পিত হচ্ছেন কিনা? আপনার পছন্দ মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা আপনার অধিকার। সেই অধিকার হরণ হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকুন, সেটি ঘর-বাইরে, যে পরিসরেই ঘটুক না কেন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ