X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

গো হোম, পদ্মা সেতু এবং বন্যার রাজনীতি

মোস্তফা হোসেইন
২১ জুন ২০২২, ২০:৪৯আপডেট : ২১ জুন ২০২২, ২০:৪৯

গণমাধ্যমে এখন তিনটি বিষয় গুরুত্বসহ আলোচনায় আসছে। দুটি সাম্প্রতিক এবং একটি দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক দুর্ভোগ। ধারাবাহিক দুর্ভোগের হাত থেকে মুক্তির একটি স্লোগান ‘গো হোম’।  বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সমাবেশ করে দেশে ফেরার দাবি জানিয়েছে রোহিঙ্গারা। ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’(এআরএসপিএইচ) নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ৩৪টি সমাবেশে ১৫/১৬ লাখ রোহিঙ্গার প্রাণের দাবি প্রকাশ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নানা বিব্রতকর কাজের পরও বোধকরি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই চায় রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যাক এবং বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথর সরে যাওয়ার জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ১৫-১৬ লাখ মানুষের বোঝা বইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কিছু ত্রাণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং সম্পদ বিনষ্টের জন্য এই বিশাল জনগোষ্ঠী নিত্য নিয়োজিত তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবতা দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে প্রতিদিন। এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও আঁচড় দিচ্ছে। কী ভয়াবহ চিত্র তা বোধকরি অনেকেরই জানা নেই। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের তহবিল থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা খেসারত দিতে হচ্ছে। ২৫ আগস্ট ২০২০ সালের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যায়, পূর্ববর্তী তিন বছরে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয় যে অনেক অনেক বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগের সেই হিসাবে প্রতিবছর একটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান টাকা আমাদের খরচ করতে হয়েছে বিদেশি এই নাগরিকদের জন্য। পদ্মা সেতুর ব্যয় নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, অথচ পুরো সেতুর বাজেট বাংলাদেশকে এক বছরেই শেষ করে দিতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য।

যে মুহূর্তে রোহিঙ্গারা দেশে ফেরার জন্য সমাবেশ করছে, যে মুহূর্তে মুসলিম উম্মাহর সেবা করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে একেকটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমান অর্থ ওদের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে, ঠিক তখনই কিছু মহল বিভিন্ন মাধ্যমে উপদেশ দিচ্ছেন, এই মুহূর্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল করা হোক। কারণ, অর্থ সাশ্রয় করে সেই টাকা সিলেট অঞ্চলে বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করা হোক। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয় কতই বা হবে? ১ কোটি ২ কোটি টাকা! সেই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এই টাকা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষের জন্য ব্যয় করার পরামর্শ তাদের।  

সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় দুর্ভোগে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্র এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য ফরজের শামিল। কিন্তু প্রশ্ন আসে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে সেই টাকা বন্যার্তদের জন্য ব্যয় করতে হবে কেন। বন্যার্তদের আহার ও সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এর ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। তাই বলে উপদেশকারীদের উপদেশ অনুযায়ী একটা বন্ধ করে আরেকটাকে সহযোগিতা করতে হবে কেন? এখানেই প্রশ্ন এসে যায়। তারা একবারও মুসলিম উম্মাহর সহযোগিতার জন্য যে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কিছু বলছেন না। তাদের দৃষ্টি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে। যেখানে হয়তো ব্যয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২-৩ কোটি টাকা হতে পারে; কিংবা তার চেয়েও কম। এই পরামর্শের পেছনে কি বন্যার্তদের প্রতি মায়া নাকি অন্যকিছু?

কয়েক দিনের প্রতিক্রিয়া দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটা শ্রেণি এর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা শুরু করে। কিন্তু যে মুহূর্তে সিলেট অঞ্চলে বন্যা আঘাত হানে তখনই তাদের সমালোচনা শুরু হয় বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। বন্যার আগে তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল এটা সরকারের রুটিন ওয়ার্ক, এত হইচই কেন? দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি প্রকল্প নিয়ে এত মাতামাতি লজ্জাজনক ইত্যাদি। কিন্তু যে মুহূর্তে বন্যা সুনামগঞ্জ ও সিলেটকে ভাসিয়ে দিয়েছে তখন শুরু হয়েছে বন্যার্তদের সহযোগিতা বাদ দিয়ে কোনও কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জমকালো অনুষ্ঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, বন্যার্তদের সহযোগিতা কি বাদ দেওয়া হয়েছে?

সারাক্ষণ টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে অতি জরুরি বিষয় হিসেবে বন্যার খবর প্রচার করছে। মানুষের দুর্ভোগের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি তাদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থার সংবাদও আমরা দেখতে পাচ্ছি। শুরু থেকে সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজসহ ত্রাণ বিতরণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ঝড়-বন্যা-ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের দুর্ভোগ শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। যত সহযোগিতাই করা হোক না কেন, দুর্ভোগ হবেই। আর এ ধরনের দুর্বিপাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেও কার্পণ্য করা হয় না। এটা যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। একইসঙ্গে এমন ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাও সম্ভব হয় না। এগুলো স্বীকার করতে দ্বিধা থাকার কথা নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি করাটা আদৌ উচিত কি না। প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ এখন জীবনযুদ্ধে লিপ্ত। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করা এই মুহূর্তে অতি জরুরি। আর এমন দুর্যোগকালে পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠানকে টেনে আনা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার।

একটা উদাহরণ দিতে পারি। প্রবীণদের মনে থাকার কথা, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। কী ভয়ংকর ছিল সেই জলোচ্ছ্বাস। প্রায় ৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল সেই জলোচ্ছ্বাসে।  সে কী দৃশ্য! কয়েকদিন পরও গাছের আগায় পাওয়া গেছে মানুষের লাশ। নদী আর সাগরের তীরে পড়ে ছিল মৃত মানুষ। সেই পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে আসে পাকিস্তানের নির্বাচন। সন্দেহ দানাবেঁধে ওঠে আদৌ নির্বাচন হবে তো? সন্দেহটা ঘনীভূত হয় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ঘোষণায়। মওলানা সাহেব বললেন, এমন অবস্থায় নির্বাচন হতে পারে না পাকিস্তানে। তার দল তখন স্লোগান দিলো– ভোটের বাক্সে লাথি মারো বলে। কিন্তু ওই সময়ের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, নির্বাচন হবে। শুধু উপদ্রুত এলাকাগুলো নির্বাচনের আওতার বাইরে থাকবে। মানুষ কিন্তু নির্বাচনে গেলো। ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন হয়েছিল বাঙালির, আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে দুর্গতদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল আপামর জনসাধারণ। একদিকে নির্বাচনি প্রচারাভিযান অন্যদিকে ত্রাণ তৎপরতা চললো একইসঙ্গে।

আজকে যারা বলছেন বন্যার কারণে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, তাদের ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাস পরিস্থিতির কথা ভাবতে বলবো।

এই নিবন্ধ লেখার সময় টেলিভিশনে সংবাদ হচ্ছে পাটুরিয়া ঘাটে হাজারখানেক মালবাহী ট্রাক আটকা পড়ে আছে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই ট্রাকগুলোর অধিকাংশই পাটুরিয়ার পরিবর্তে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে। এমনকি বন্যাকবলিত এলাকায় পণ্যসামগ্রী পরিবহনে এই সেতু সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বন্ধ করার জন্য যারা ওকালতি করছেন তাদের বাস্তবতা মানতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক আবরণে ঢেকে গেছে। বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান বাতিলের কথা যারা বলছে, তারা একবারও চোখ ফিরায় না রোহিঙ্গাদের দিকে। আসলে তাদের দৃষ্টি বন্যাদুর্গতরা নয়, তাদের ভাবনায় বাংলাদেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়া।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার ঐতিহ্য ভেঙে গেছে আমাদের। সবসময় আমরা দেখেছি, এ ধরনের দুর্যোগে পাড়ায় মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করেছে। পাড়ার মোড়ে পুরনো কাপড়ের স্তূপ কিংবা চিড়া-মুড়ির প্যাকেটের স্তূপ ইত্যাদি। পাকিস্তান আমলে দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহ হতে। এমনকি ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ঢাকার কাঁঠালবাগানে আমার পরিচিত এবং পারিবারিক একজন চিকিৎসক বন্যার্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

যারা আজকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয় দিয়ে বন্যার্তদের সহযোগিতার পরামর্শ দিচ্ছেন তাদেরও নাগরিক দায়িত্ব আছে কমবেশি। তারা কে কী করছেন সেই প্রশ্নটিও কিন্তু এসে যায়।

লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে, পুরো বাংলাদেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য, আর আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে ১৫-১৬ লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা সমস্যা আকস্মিক বন্যা সমস্যার চেয়ে কম নয়। যারা পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান বাতিলের কথা বলছে তাদেরও সোচ্চার হতে হবে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর দাবিতে। মানুষের জীবন নিয়ে আর যাই হোক, রাজনীতি না করাই উত্তম।  

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ এড়ালো শারমিনরা
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ এড়ালো শারমিনরা
সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ গমন তদন্তে তিন উপদেষ্টার কমিটি
সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ গমন তদন্তে তিন উপদেষ্টার কমিটি
ভুটানকে অনায়াসে হারিয়ে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ
ভুটানকে অনায়াসে হারিয়ে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ
৩ দিনের তাপপ্রবাহে অতিষ্ট জনজীবন, সোমবার থেকে কমতে পারে
৩ দিনের তাপপ্রবাহে অতিষ্ট জনজীবন, সোমবার থেকে কমতে পারে
সর্বশেষসর্বাধিক