X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফজিলাতুন নেছা: বঙ্গবন্ধুর শুধু স্ত্রী নন, ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা

মাসুমা সিদ্দিকা
০৮ আগস্ট ২০২২, ১৮:০৩আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২২, ১৮:০৩

অনেক জগদ্বিখ্যাত মানুষের পেছনে এমন একজন থাকেন যার সহযোগিতায়, অনুপ্রেরণায় তাঁরা এগিয়ে চলেন সামনে। কিন্তু পর্দার আড়ালে থাকা এসব মানুষের কথা সেভাবে আমরা জানি না বা তাঁদের তেমন করে স্মরণ করা হয় না। এমনই একটি নাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, যিনি ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী। বঙ্গবন্ধুকে  যিনি অনেক উচ্চ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি তাঁর কর্মের দ্বারা আমাদের বঙ্গমাতা হয়ে উঠেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন সবসময়, ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে সাহস জুগিয়েছেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন। কিছু রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে, কিছু দিবসে তাকে নিয়ে কিছু আলোচনা করা হয় বটে, কিন্তু তাঁর অবদান নিয়ে যথার্থ কোনও গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক বড় বড় অর্জনের পেছনে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন এই মহীয়সী নারী। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যে বইটি আমরা পাই, সেটি লেখার পেছনেও ফজিলাতুন নেছার রয়েছে এক বিশাল অবদান। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে আত্মজীবনী লেখার জন্য পরামর্শ দেন এবং লেখার জন্য সবকিছুর উপকরণও জোগাড় করে দেন তাঁর স্বামীকে, যেন জেলের এই সময়টাকে কাজে লাগাতে পারেন ভবিষ্যতের জন্য। আর তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুপ্রেরণায় লিখেন তার বিখ্যাত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ফজিলাতুন নেছা বলেছিলেন, "বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।" (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১)

স্বামীর সুখে নিজের সুখ মনে করেছেন তিনি। রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে যা টাকা থাকতো তার সব খরচ হয়ে যেতো। আর আর রাজনীতির বাইরে অন্য কোনও পেশায় জড়িত না থাকা বঙ্গবন্ধুকে তখন টাকার জন্য শরণাপন্ন হতে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে। আর কখনও তাঁদের কাছে টাকা না পেলে তার সহধর্মিণীর কাছে পেতেন, যিনি কিনা নিজের শখ না মিটিয়ে তিনি টাকাগুলো জমিয়ে রাখতেন তাঁর প্রাণপ্রিয়র জন্য। একজন নারীর স্বামীর প্রতি কতখানি ভালোবাসা থাকলে, বিশ্বাস থাকলে নিজের শখ না মিটিয়ে স্বামীকে অবলীলায় টাকা দিতে পারেন তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

বঙ্গবন্ধু জীবনের বেশিরভাগ অংশই জেলে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা তখন একাই অম্লান বদনে শুধু যে সংসার সামলেছেন তা কিন্তু নয়, তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বন্ধুবান্ধবদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন, রাজনীতির খবর নিয়েছেন; দিয়েছেন তাদের প্রয়োজন মতো পরামর্শ; করেছেন আর্থিক সহায়তাও। কেউ বিপদে পড়লে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। কোনও সংসারের  কর্তাব্যক্তিটি যদি বাড়িতে না থাকেন তবে গৃহকর্ত্রীর ওপর যে কী ভীষণ চাপ বয়ে যায় সবদিক সামলাতে সেটা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি। কিন্তু আমাদের বঙ্গমাতা এই কাজটা কত অনায়াসেই সুচারুরূপে করে গেছেন। কাউকে বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি। কোনোদিন অভিযোগ কিংবা অনুযোগ করেছেন বলে শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধুও তাঁর স্ত্রীর এই অবদানের কথা সবসময় স্বীকার করে গেছেন।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যখন বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে সমাবেশের অনুমতি দেন, তখন ফজিলাতুন নেছা বলেন, যদি সমাবেশে যোগ দিতেই হয় তবে মুক্তভাবে, বন্দি হয়ে নয়। শেখ মুজিবও রেণুর কথা শুনেছিলেন এবং প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সমাবেশে যোগ দেননি। আর যার ফলে প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু নিঃশর্ত মুক্তি পান। সাধারণ একজন গৃহিণী হয়েও তিনি যে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে, তা সত্যিই দুর্লভ। ৬ দফা আন্দোলনের সময় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ না দেওয়ার জন্য পরামর্শ, ভুট্টোর সঙ্গে ছয় দফা নিয়ে সমঝোতা না করার পরামর্শ সত্যিই তার দূরদর্শিতার পরিচায়ক। বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে যাবেন, তখনও তিনি ফজিলাতুন নেছার পরামর্শ শুনেছিলেন। স্বামীকে ডেকে তিনি অন্য  নিত্যদিনের মাড়ানো পথ ব্যবহার না করে অন্য পথ দিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তার সাথে আর কে কে যাচ্ছেন সেটাও তিনি শুনেছেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর যা ইচ্ছা হয়, নিজের বুদ্ধিতে যেটা ভালো মনে হবে সেটাই যেন তিনি বলেন।  অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়, স্ত্রীর  এই  অটুট আস্থা, অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অটল থাকতে অনেক সাহায্য করেছে। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক আওয়ামী লীগের আরেক নেতা শামসুল হকের বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী সময়ে স্ত্রীর বিভিন্ন চাপে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে তুলনা করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি ফজিলাতুন নেছার দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ফজিলাতুন নেছা তার ছোট দুই ছেলে রাসেল ও জামালকে নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে হানা দেয় এবং লুটপাট করে অনেক কিছুই ভাঙচুরও করে। সেই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের সঙ্গে একটা ড্রেসিংরুম ছিল। যেখানে একটা আলমারির ওপরে এক কোণে বঙ্গবন্ধুর জেলখানা জীবনের খাতাগুলো যত্ন করে রাখা ছিল, যা রেখেছিলেন তার সহধর্মিণী। তিনি এমনই গোছালো, যত্নময়ী ছিলেন যে স্বামীর সবকিছু অনেক যত্নে আগলে রাখতেন ভবিষ্যতের জন্য। তাই হয়তো বা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, ভবিষ্যৎ বাঙালিদের কথা চিন্তা করে তিনি এই বইগুলো সংরক্ষণ করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু স্ত্রী সম্পর্কে কখনও কোনও অভিযোগ করেননি। রেণু সবসময় স্বামীকে আগলে রাখতেন। স্বামীর খাবার দাবারের প্রতি ভীষণ রকম যত্নবান ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু একটু রোগা ছিলেন। তাই সবসময় ফজিলাতুন নেছা নিজের হাতে স্বামীর জন্য রান্না করতেন। তিনি স্বামীর জন্য ননী, ছানা, দুধ, ঘি এসবের আয়োজন রাখতেন সবসময়। নিজের খাবারের প্রতি মনোযোগী না থেকে স্বামীর খাবারের প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন। যখন শেখ মুজিব জেলে থাকতেন তখনও তিনি নিজ হাতে মুজিবের পছন্দের রান্নাগুলো করে পাঠিয়ে দিতেন। শুধু যে খাবারের প্রতি যত্নবান ছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি তার স্বামীর জামাকাপড়ের প্রতিও তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। সবসময় ফজিলাতুন নেছা স্বামীকে পরিপাটি করে জনসভায় পাঠাতেন আর তাতে আমরা ফজিলাতুন নেছার আদর্শ রুচিবোধেরই  পরিচয় পাই। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও তিনি সাধারণ জীবন কাটিয়েছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অলংকার, আসবাবপত্র কিছুই তার ছিল না। অনেক সময় তিনি নিজের অলংকার-আসবাবপত্র বিক্রি করেও দলের নেতাকর্মীদের সাহায্য করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর যে দীর্ঘ সংগ্রামের কথা আমরা জানি তার ক্ষুদ্র পরিসরেই আমরা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে পাই।  তার সম্বন্ধে আলোচনা যেন বঙ্গবন্ধুর সংসারে  অবদান নিয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কথা তো আরও বৃহৎ পরিসরে জানার, আলোচনার ছিল, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। আজ বাংলাদেশে তার নামে অনেক ছাত্রাবাস, কলেজ স্থাপিত হলেও তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য সেগুলো যথেষ্ট নয়। তাঁকে জানবার জন্য, তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য আমাদের আরও গবেষণা দরকার, আরও বৃহৎ পরিসরে তাঁকে জানার ব্যবস্থা করা দরকার। একজন নারী যিনি তার সারাটা জীবন শেখ মুজিবকে নিরলসভাবে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি, তাঁর সেই জীবন ও দর্শনকে আরও বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক মহীরুহ হয়েও তিনি প্রদীপের আলোয় থাকেননি। তাই বঙ্গবন্ধু ও এ দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে হলে অবশ্যই ফজিলাতুন নেছাকে নিয়েও যথাযথভাবে গবেষণা করতে হবে।
ফজিলাতুন নেছাকে শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবে না দেখে বরং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ও উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করে তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনা করা এই জাতির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসের স্বার্থেই প্রয়োজন।


লেখক: রন্ধনশিল্পী ও কলাম লেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় ২ জঙ্গি নিহত
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় ২ জঙ্গি নিহত
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ