X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মান-অভিমান সে তো হৃদয়েরই টান’

প্রভাষ আমিন
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৪৪আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৪৪
বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর যতটা প্রিয়জন, তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। তবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তাদের আদর্শিক ঐক্য। সেই আদর্শিক ঐক্যটা থাকলেও প্রয়োজনটা অনেক কমে এসেছে। তাই অনেক দিন ধরেই তাদের প্রেমটা আলগা আলগা ছিল। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান হঠাৎ সেই আলগা প্রেমে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন। জামায়াতের আমিরের জোট ছাড়ার ঘোষণা নিয়ে এখন রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। বিএনপি এ ব্যাপারে এখনও মুখ খোলেনি, আর জামায়াতের নেতারাও আমিরের বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মত’ হিসেবে অভিহিত করতে চাইছেন। কিন্তু দলের আমিরের বক্তব্য কীভাবে ব্যক্তিগত মত হয়, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

প্রিয়জন আর প্রয়োজনের ব্যাখ্যাটা আগে দেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের নানা ঘটনাপ্রবাহে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারায় পুনর্জাগরণ ঘটে। স্বাধীনতার পর রাজনীতি করার অধিকার হারিয়ে গর্তে ঢুকে যাওয়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার মাঠে নামার সুযোগ পায়। এই সুযোগে জামায়াতও মাঠে নামে। জিয়াউর রহমানের কল্যাণে দেশে ফিরে আসার সুযোগ পায় রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযম। তাই বিএনপি পরিণত হয় জামায়াতের প্রিয়জনে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের পাশাপাশি মাঠে থেকে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রমাণে সচেষ্ট থাকে। তবে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ৯১ সালের নির্বাচনে প্রিয়জন বদলে যায় প্রয়োজনে। বিএনপির সঙ্গে গোপন সমঝোতার নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পায় ১৮টি আসন। আর বিএনপির সরকার গঠনের জন্য জামায়াতের সমর্থনের বিকল্প ছিল না।

তবে ৯৬ সালের নির্বাচনে নিজেদের একক শক্তি যাচাই করতে গিয়ে জামায়াত বিএনপির প্রয়োজনটা আরও বেশি অনুভব করে। সেবার তারা পেয়েছিল মাত্র ৩টি আসন। এরপর প্রিয়জন, প্রয়োজন আর আদর্শিক ঐক্য মিলে সৃষ্টি হয় এক কঠিন প্রেমের, গঠিত হয় চারদলীয় ঐক্যজোট। বিএনপি বুঝে যায় ক্ষমতায় যেতে হলে জামায়াতের ভোট তাদের লাগবেই। আবার জামায়াতও বুঝে যায় বিএনপিকে ছাড়া চলতে গেলে তারা টিকতে পারবে না। চারদলীয় জোটে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট থাকলেও ভোটের মাঠে মূল শক্তি ছিল বিএনপি আর জামায়াতই। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে, রাজাকারদের গাড়িতে ওড়ে জাতীয় পতাকা। কিন্তু ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে প্রিয়জন, প্রয়োজন সব অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে কিছু ভোট আছে জামায়াত আর জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হিসাব মেলাতে জামায়াতের কাউন্টার হিসেবে কাছে টানে জাতীয় পার্টিকে। ভোটের হিসাব মিলেও যায়। তারপর থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আর অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত বিএনপি ও জামায়াত। আওয়ামী লীগ আগেই বুঝেছিল, বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে থাকাটা তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জামায়াতের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নিজেরাই এখন চরম বিপদে আছে। তবে তাদের চেয়েও বড় বিপদে জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে একদিকে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন, অন্যদিকে জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করেন। দুটিই বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য আনন্দের সংবাদ। তবে জামায়াতের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বিবেচনা করলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এত বড় বিপদে তারা কখনোই পড়েনি। প্রবল দাবি সত্ত্বেও সরকার যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি বটে, তবে দলটি নিবন্ধন হারিয়েছে। তাই তাদের এখন একা চলার শক্তি নেই। কিন্তু দলের এত বড় বিপর্যয়েও প্রিয়জন বিএনপিকে পাশে পায়নি জামায়াত। আসলে পাশে থাকার উপায়ও ছিল না। বিএনপির নিজেদেরই এখন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ দশা। আর নির্বাচনি ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় বিএনপির কাছে জামায়াতের প্রয়োজনটা কমে আসে। কাগজে-কলমে ২০ দলীয় জোট থাকলেও বাস্তবে অনেক দিন ধরেই এই জোট অকার্যকর। ২০ দলীয় জোট থাকার পরও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আবার নতুন মিত্রের খোঁজে মাঠে নেমেছে। কিন্তু এই মিত্রের খোঁজ করতে গিয়েই বিপাকে পড়তে হয় বিএনপিকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনও শক্তিই জামায়াত থাকলে বিএনপির সাথে থাকতে রাজি নয়। আন্তর্জাতিক মহলেও যুদ্ধাপরাধী দলের সাথে জোটবদ্ধতা নিয়ে বিএনপিকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। তাই জোট থাকলেও বিএনপি অনেক দিন ধরেই জামায়াতকে না চেনার ভান করছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপির ভেতরেই জামায়াতকে নিয়ে ভিন্নমত আছে। জামায়াতের সাথে জোট করায় অনেকেই বিএনপি ছেড়েছেন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। তাই ভোটের মাঠের প্রয়োজন জামায়াত এখন রাজনীতির মাঠে বিএনপির জন্য বোঝা হয়ে গেছে।

সব মিলে জামায়াতের এখন অভিমানকাল। বিপদের সময় পাশে না পাওয়া বিএনপিকে আর তারা বন্ধু মনে করতে পারছে না। ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়’ এই তত্ত্ব মেনে জামায়াত এখন বিএনপিকে ছাড়তে চাইছে। আওয়ামী লীগ অনেক দিন ধরেই বিএনপি-জামায়াতের জোট ভাঙার চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ মনে করছেন, জামায়াতের বিএনপি ছাড়ার চেষ্টা আসলে সরকারের সুনজর পাওয়ার চেষ্টা হতে পারে। এভাবে যদি তারা নিবন্ধন ফিরে পায়, তাহলে তারা সামনের দিনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াতের বিএনপি ছাড়ার ঘোষণায় সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাদের ধারণা, এখন আলাদা মনে হলেও নির্বাচনের সময় ঠিকই তারা এক হয়ে যাবে। জামায়াতের আমিরের জোট ছাড়ার ঘোষণা বিএনপির সাথে গভীর প্রেমের সত্যি সত্যি ব্রেকআপ নাকি অভিমান; সেটা আপাতত সময়ের হাতেই তোলা থাকলো।
 
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ