X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন হবে জাতীয় সরকার এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ?

রুমিন ফারহানা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৪৭আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৪৭

বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির প্রতিবাদে এক মাস ধরে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করছে বিএনপি। এই কর্মসূচিতে সহিংসতায় প্রাণ গেছে বিএনপির চার জন কর্মীর, আহত হয়েছে অসংখ্য, আবার মামলা হয়েছে বিএনপির কর্মীদের বিরুদ্ধেই। সরকারের তরফ থেকে একদিকে যেমন বলা হয়েছে আন্দোলনে কোনও বাধা দেওয়া হবে না, অন্যদিকে তেমনি উসকানিও থেমে নেই। সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে হরহামেশাই বলা হচ্ছে, বিএনপিকে কী করে গর্তে ঢুকাতে হয় সেটা জানা আছে কিংবা যুবলীগ মাঠে থেকে প্রতিহত করবে ইত্যাদি। এই ধরনের হাঁকডাক, উত্তর প্রত্যুত্তর অনিবার্য সংঘাতেরই ইঙ্গিত দেয়।

বিএনপির মিডিয়া সেল বিভাগীয় শহরগুলোতে আয়োজন করছে সুধী সমাবেশের। বিষয় খুব পরিষ্কার। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোয় যে মৌলিক পরিবর্তন আনবে, তার আলোকে আলোচনা। বিএনপি ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ভার পেলে বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে এবং সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট।

নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকারের ধারণাটি নতুন। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন নির্বাচনের আগে আগে জাতীয় সরকারের ধারণা একরকম কিন্তু নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার কেমন হবে? সেই বিষয়েই রাজনৈতিক দল, সুধী সমাজের সাথে দফায় দফায় আলোচনা, মতবিনিময় করছে বিএনপি।

জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা সামনে রেখে সরকারবিরোধী সব দল-মতকে সঙ্গে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাইছে বিএনপি। বিএনপি মনে করে, গত ১০ বছরে দেশের সমাজ ও মূল্যবোধের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। এ অবস্থায় সমাজ, আইনশৃঙ্খলা, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না; এসবের বড় আঙ্গিকে মেরামত করতে হবে। রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে তাই সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা জরুরি।  

বিএনপির পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে এই লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক পথরেখা তৈরি করা হচ্ছে, সেটি হবে মূলত ‘পরিবর্তনের কর্মসূচি’। যেখানে সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশনসহ (পিএসসি) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় আঙ্গিকে সংস্কারের অঙ্গীকার থাকবে। তবে বিএনপি মনে করে সবাই মিলে ঠিক করতে হবে কোথায় কোথায় এর মেরামত বা সংস্কার করতে হবে।

বিএনপি অংশীদারিত্বে বিশ্বাস করে। বিএনপি বিশ্বাস করে রাষ্ট্র মেরামতের এই কাজ জয়ী এবং বিজিত হাতে হাত রেখে করতে পারে। ছোট ছোট অনেক দল আছে, যাদের প্রধান প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ নেতা। তাদের পরামর্শ রাষ্ট্র মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এত বড় সংস্কারের কাজটি বিএনপি একা করতে চায় না বা বিশ্বাস করে একা করা তাদের পক্ষে সমীচীন হবে না।

রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমাদের আইন সভার (সংসদ) সংস্কার। গণতন্ত্রকে কীভাবে মানুষের জন্য আরও বেশি কল্যাণকর করে তোলা যায়, সেটা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে। মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের মূল চেতনা অর্থাৎ Of the people, by the people, for the people সরকার নিশ্চিত করা যায়।

মধ্যযুগীয় সম্রাট শাসিত রাজ্যগুলোর সাথে আধুনিক, কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে একেবারে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে– একটা আধুনিক কার্যকর রাষ্ট্রে ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ থাকে। একটা আধুনিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। প্রতিটি বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এটা খুব স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল সেই রাষ্ট্রটিই সবচেয়ে ভালোভাবে টিকে থাকে এবং তার নাগরিকদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে পারে যার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে।

একটা রাষ্ট্র যার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে সেখানে জনগণের স্বার্থের জন্য এমনকি শাসকের স্বার্থ‌ও লঙ্ঘিত হতে পারে। তাই কোনও শাসক যদি যেকোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়, ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের স্বার্থ নষ্ট করতে তার কোনও দ্বিধা না থাকে, তাহলে তার প্রধান কৌশল হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলা।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে আইন বিভাগ। নামে আইন বিভাগ হলেও প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন ছাড়াও এই বিভাগ রাষ্ট্রীয় সব গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ এবং কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কীভাবে এই বিভাগটিকে আরও ক্ষমতাবান করা যায়, সেই আলোচনা গণতন্ত্রের শুরুর দিক থেকেই ছিল।

আইন বিভাগ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার চাইতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিতে অনেক বেশি কার্যকর। এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কখনও কোনও দল কোনও নির্বাচনে সংসদে অনেক বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই সেই দলকে এবং তার প্রধানকে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পর্যাপ্ত বাধা দিতে পারে না। সেই কারণেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা এসেছে; শাসন বিভাগের পক্ষে একই সাথে সংসদের দুটি কক্ষের নিয়ন্ত্রণে খুব সহজ নয়।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা আছে। সংসদের দুটি কক্ষ থাকলে সেটি যেকোনও আইন কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনার জন্য অনেক বেশি সময় পায়। সংসদের উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের কর্মপরিধি ঠিক করে নেওয়ার মাধ্যমে এক ধরনের ডিভিশন অব লেবার নিশ্চিত করে, যার মাধ্যমে যাবতীয় কাজ সুচারুভাবে করা সম্ভব হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চকক্ষের সদস্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম বেশি বয়স এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, তাই সেটা এই হাউজের কাজকে অনেক ম্যাচিওরড করে। সংসদের নিম্নকক্ষের নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে পরিবর্তন পরিবর্ধন এমন‌কি বাতিল করা সম্ভব হতে পারে উচ্চকক্ষে।

সংসদের উচ্চকক্ষ মূলত ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিন্তু ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড, ফিলিপিনসের মতো এককেন্দ্রিক দেশেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ আছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে যখন চিন্তা আসে তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সংসদের উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হবে। বর্তমান পৃথিবীতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্ধারণে দেখা যায়, নিম্নকক্ষের তুলনায় উচ্চকক্ষের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার নিম্নকক্ষ ‘হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’-এ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ২৫ প্রয়োজন হলেও উচ্চকক্ষ সিনেটের ক্ষেত্রে এটা ৩০। ঠিক একই রকম বয়সের বাধ্যবাধকতা আছে ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভা এবং উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার ক্ষেত্রেও। খুবই ইন্টারেস্টিং নিয়ম আছে ইতালিতে। সেখানে উচ্চকক্ষে নির্বাচিত হবার জন্য ন্যূনতম বয়স ৪০, এবং সেই উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে ভোটাধিকার আছে শুধু মাত্র ২৫ বছরের বেশি বয়সীদের।

অর্থাৎ সংসদের উচ্চকক্ষ এমন সদস্যদের নির্বাচিত করবে যারা নিম্নকক্ষের চাইতে বয়সে, অভিজ্ঞতায় বেশি পরিণত। বিএনপি ক্ষমতায় এলে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হবে ‘ব্রিটেনের হাউজ অব লর্ডস’-এর আদলে; অর্থাৎ সদস্যরা নির্বাচিত না হয়ে সিলেক্টেড হবেন। উচ্চকক্ষের সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার শর্ত না থাকার পেছনে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি। সংসদ সদস্যরা যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন তখন চাইলেও তাদের পক্ষে অনেক সময় পপুলিস্ট না হয়ে উপায় থাকে না।  কিন্তু রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণের জন্য জরুরি অনেক পদক্ষেপ সবসময় স্বল্পমেয়াদে জনগণকে সুখী করে না; বরং করে তোলে বিক্ষুব্ধ। তাই তাদের পক্ষে অনেক সময় এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এই বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম না থাকলে উচ্চকক্ষের সদস্যদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই খুব দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

শুধু তা-ই না, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়, যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে যেতে হয়, সেটা সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই উচ্চকক্ষের জন্য সদস্য যদি নির্ধারণ করা হয় তাহলে সেখানে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

জাতীয় সরকারের গঠন প্রক্রিয়া কেমন হবে কিংবা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সদস্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কেমন হবে সেই আলোচনা চলতেই পারে, হতে পারে তর্কবিতর্ক। তবে বিএনপির এসব প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার। রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর যেকোনও নতুন ভাবনা বিএনপির হাত ধরেই এসেছে বারবার, সেটি যতই নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে হোক না কেন।

তাই অদূর ভবিষ্যতে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতকরণে জাতীয় সরকার কিংবা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের মতো কোনও পদক্ষেপ নিতে বিএনপি ন্যূনতম দ্বিধা তো করবেই না; বরং তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য বিএনপি দলীয় হুইপ।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ