X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের ‘উচিত শিক্ষা’!

প্রভাষ আমিন
১০ নভেম্বর ২০২২, ২০:৩৪আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২২, ২০:৩৫

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক চক্র শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, কনিষ্ঠতম সদস্য শেখ রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। একই সময়ে হামলা করে বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, দুই স্বজন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনিকেও হত্যা করেছিল। তাদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার ছিল, বঙ্গবন্ধুর যেন কোনও রক্তের উত্তরাধিকার না থাকে। ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারীদেরও নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা ছিল। বাংলাদেশে যাতে আর কেউ আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে না পারে, সে ব্যাপারে মরিয়া ছিল খুনি চক্র। ৭৫-এর পর সত্যি সত্যি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়ার উপায় ছিল না। পরের ২১ বছর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন জাতির জনকের নাম। কিন্তু খুনি চক্রের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। দেশের বাইরে থাকায় ঘাতকের বুলেট নাগাল পায়নি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাও কম হয়নি। অন্তত ১৯ বার তার ওপর হামলা হয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন। দেশে ফেরার পর থেকে গত চার দশকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ আজ অন্যরকম উচ্চতায়। শেখ হাসিনার এই চার দশকের পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বন্ধুর পথে বন্ধুর চেয়ে শত্রু, ষড়যন্ত্রকারীর সংখ্যাই ছিল বেশি। নিষ্ঠুর হামলা, ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র, শত সংগ্রাম শেষেই শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এই লড়াইয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তৃণমূলে বিস্তৃত আওয়ামী লীগের সংগঠন। ঘাতক চক্র ৭৫-এ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করলেও তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা কর্মীদের ধ্বংস করতে পারেনি। কৃষকরা প্রতিবছর চাষবাস শেষে পরের বছরের জন্য কিছু বীজ রেখে দেন। সেই বীজ থেকেই আবার ফলে ফসল। ৭৫-এর পর শত নির্যাতন নিপীড়নেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকা এই কর্মীরাই আওয়ামী লীগের বীজ। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এই বীজ পেয়েছিলেন বলেই আবার ফসল ফলাতে পেরেছেন। শেখ হাসিনা এই তৃণমূলের অবদানের কথা সবসময় স্মরণ করেন। তিনি বারবার একটি কথা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের কেনা যায়, কিন্তু তৃণমূল কর্মীদের কেনা যায় না।

গত ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই সময়ে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে অনন্য উচ্চতায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন দেশের অর্থনীতি একটু চাপে থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানো। এই ১৩ বছরে দেশের যেমন উন্নয়ন হয়েছে, লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও। তবে সেই লাভের গুড় সুসময়ের পিঁপড়ায় খেয়েছে। ক্ষমতার স্রোতে ভেসে আসা কচুরিপানায় রুদ্ধ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের প্রাণ। স্মার্ট হাইব্রিডদের দাপটে এখন কোণঠাসা তৃণমূলের পোড়খাওয়া আনস্মার্ট নেতৃত্ব।

গত ১৩ বছরে মাঠে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য। নানান কৌশলে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে কোণঠাসা করে রেখেছে। কিন্তু এই ১৩ বছরে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষতিও কম হয়নি। কোন্দলে কোন্দলে বিপর্যস্ত এখন আওয়ামী লীগের তৃণমূল। ভোটের মাঠে কোনও প্রতিপক্ষ না থাকলেও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয় সহজ হয়নি। দলীয় প্রতিপক্ষ আর বিদ্রোহী প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলেন।

গত ১৩ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। কয়দিন আগে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া অন্তত ১০ জন চেয়ারম্যান হেরেছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের দায় পরিষ্কার।

তৃণমূলে আওয়ামী লীগের কোন্দল আগেও ছিল, কিন্তু এখন বেড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে বড় শত্রু দলীয় প্রতিপক্ষ। এমনকি দলীয় প্রতিপক্ষকে হারাতে তারা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলাতেও কসুর করে না।

আমি আওয়ামী লীগের এমন অনেক নেতাকর্মীকে চিনি, যারা শেখ হাসিনার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তার মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীকে হারাতে যতটা সম্ভব চেষ্টা করেন।

অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ ২৯৯ আসন পাক, কিন্তু আমার আসনে যেন ফেল করে। সমস্যা হলো, এমন কর্মী সারা দেশের সব আসনেই আছে এবং এই সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। আশঙ্কাটা হলো, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই যদি জান দিয়ে মাঠে নামেন, তখন রাজার দুধের পুকুর না পানি দিয়েই ভরে যায়।

সমস্যা হলো, গত দুটি নির্বাচনে মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আওয়ামী লগের এমপিরা আয়েশ করে জিতেছেন। তাদের জনগণের কাছে যেতে হয়নি, কর্মীদের সহায়তা লাগেনি। তাই জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়েছে , কর্মীদের সঙ্গে কোন্দল বেড়েছে। আওয়ামী লীগের কোন্দলের ক্ল্যাসিক উদাহরণ হলো কুমিল্লা। বাহার-আফজাল দ্বন্দ্বের কথা বাংলাদেশের সবাই কমবেশি জানেন। প্রয়াত বিএনপি নেতা কর্নেল আকবর মজা করে বলতেন, আমার দুই কর্মী বাহার-আফজাল থাকলে আমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। পারেওনি। আওয়ামী লীগের বিপুল সমর্থন থাকলেও বারবার কুমিল্লা সদরে বিএনপি প্রার্থীই জিততো। আফজাল খান মারা গেলেও দ্বন্দ্ব থামেনি। তার কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমা এখন আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন বাহারও আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া নেতা। ৯১ সালে বাহাউদ্দিন বাহার মনোনয়ন পেলেও আফজাল গ্রুপ তাকে জিততে দেয়নি। ৯৬ সালে দুই গ্রুপের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনা শামসুল হককে মনোনয়ন দিলেও কোন্দলের কারণে জেতা হয়নি তারও।

২০০১ সালে ছাত্রলীগ নেতা দুলাল হত্যা মামলার কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত বাহার স্বতন্ত্র নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামসুল হকের পরাজয় নিশ্চিত করেন। বহিষ্কৃত থাকা অবস্থাতেই  ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তারপর থেকে তিনি টানা তিনবারের এমপি। কুমিল্লার রাজনীতিতে এখন তার একক আধিপত্য। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আফজাল খানের কন্যা সীমা মনোনয়ন পেলেও বাহারের বিরোধিতায় জিততে পারেননি। গত নির্বাচনে বাহার গ্রুপের নেতা আরফানুল হক রিফাত মেয়র হয়েছেন। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহার, সাধারণ সম্পাদক রিফাত। কদিন আগে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই নেতৃত্বের প্রতিই আওয়ামী লীগ আস্থা রেখেছে। সমস্যা হলো প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের সম্মেলনস্থলে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে মারামারি হয়েছে, সশস্ত্র মহড়া হয়েছে, গুলি হয়েছে।

২০০১ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী বাহারের পক্ষে ছিল, তারাই এখন কুমিল্লা  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আর যারা সেদিন আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামসুল হকের পক্ষে ছিল, তারা এখন কোণঠাসা, সম্মেলনে ঢুকতে না পেরে মারামারি করেন।

কুমিল্লার মতো প্রতিটি জেলায় আওয়ামী লীগে তীব্র কোন্দল আছে। প্রতিটি জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগেই দলের পক্ষ থেকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করলে বা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই হুঁশিয়ারি কার্যকর হয় না। জিতে আসতে পারলে অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীই আওয়ামী লীগে মিশে যান। হেরে গেলেও কিছু দিন পর ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করে দলে ভিড়ে যান। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক এবং সংসদীয় দলের বৈঠকে দলের কোন্দল এবং জনবিচ্ছিন্নতা নিয়ে কথা হয়েছে।

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন সহজ হবে না। সবাই যেন জনগণের কাছে যান। একইসঙ্গে তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করা এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়াদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। অতীতে কখনও উচিত শিক্ষা পায়নি বলে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা বিদ্রোহ করেছেন বা দলের মন্ত্রী-এমপিরাও নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। আগামী নির্বাচন যদি সত্যি সত্যি কঠিন এবং অংশগ্রহণমূলক হয়, তাহলে তৃণমূলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে সবার আগে। কোন্দল নিরসন করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যারা বিভিন্ন সময়ে নৌকাকে ডুবিয়েছেন, তাদের সত্যি সত্যি ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে না পারলে আওয়ামী লীগই উচিত শিক্ষা পেতে পারে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ