X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ফারদিনের ‘আত্মহত্যা’ এবং আমাদের কিছু প্রশ্ন

কাবিল সাদি
২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৫৮আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৫৮

গত ৪ নভেম্বর বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নুর পরশ। রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা সাংবাদিক কাজী নুর উদ্দিন রানা। নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বলে প্রাথমিক ধারণার কথা জানিয়েছিলেন ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক। এরপর এটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে মামলার তদন্ত এগোতে থাকে।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত ৯ নভেম্বর দিনগত রাতে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগে রামপুরা থানায় মামলা করেছিলেন ফারদিনের বাবা।

এরপরই তার দুই বন্ধু বুশরা ও শীর্ষ সংশপ্তককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর গত ১০ নভেম্বর রামপুরার বাসা থেকে বুশরাকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিনই ফারদিন হত্যা মামলায় তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। বুশরা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ফারদিন নুর পরশের বান্ধবী।

ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গত ৮ নভেম্বর ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ বলেছিলেন, ‘ময়নাতদন্তে আমরা দেখতে পেয়েছি ফারদিনের মাথা ও বুকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে সেই আঘাত কোনও ধারালো অস্ত্রের নয়। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকাণ্ড।’

তদন্ত সংস্থার বরাত দিয়ে গত ১৯ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায় ‘চনপাড়া কেন্দ্রিক অপরাধীরা ফারদিন হত্যায় জড়িত’ বলে শিরোনাম করেছেন।

একইভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, ফারদিন মাদকাসক্ত ছিলেন এবং এই মাদক সংগ্রহে গিয়েই তিনি চনপাড়ার মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

এদিকে ফারদিন হত্যায় জড়িত সন্দেহে ক্রসফায়ারে নিহত হন চনপাড়ার ‘মাদক ব্যবসায়ী’ খ্যাত সিটি শাহীন নামের এক ব্যক্তি। ২২ নভেম্বর ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফারদিন হত্যার ঘটনায় শাহীন ‘কোনোভাবেই’ জড়িত নন বলে দাবি করেন তার স্ত্রী ইতি। তিনি বলেন, ‘বুয়েটের যে ছেলেটা মারা গেছে তার সঙ্গে আমার স্বামীর কোনও সম্পর্ক নেই। আমি যাতে র‌্যাবের এই হত্যার বিচার চাইতে না পারি, সেজন্য ঘটনা এইদিকে নিয়েছে।’

এই যে এত অল্প সময়ে এত  ঘটনার এত পরিক্রমা শেষে আইন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন জানাচ্ছে আসলে ফারদিন নুর আত্মহত্যা করেছেন। হত্যাকাণ্ড দাবির পেছনে প্রমাণ হিসেবে যেমন প্রাসঙ্গিক ভিডিও ক্লিপ দেখিয়েছিলেন, এবার আত্মহত্যার পেছনেও প্রমাণস্বরূপ প্রাসঙ্গিক ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছেন তারা।

তাহলে আমাদের প্রশ্ন, একটি মৃত্যুকে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে তাতে কি একজন ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পাবে? ফারদিন যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তাহলে তার বান্ধবী কেন এখনও কারাগারে থাকবেন, কেনই বা তার মা-বাবা তার জন্য আদালত বা গণমাধ্যমের কাছে আকুতি-মিনতি করবেন। কেনই বা এই ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে ‘সিটি শাহীন’ নামের ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ারে’র শিকার হবেন। ফারদিন আত্মহত্যা করে থাকলে এবং ‘সিটি শাহীনে’র স্ত্রীর দাবিই যদি সত্যি হয় যে তার স্বামী এ হত্যাকাণ্ডে যুক্ত নয়, তাহলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে দায় এড়াবেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা যে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত সেটাই বা উত্তরণে কতটা অগ্রগতি হচ্ছে এসব ‘ক্রসফায়ার’ ঘটনায়।

ফারদিনের মতো তো বুশরাও একজন শিক্ষার্থী, পাশাপাশি সে একজন নারী হিসেবে সমাজে যে ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হলো বা এখনও হচ্ছে, তার দায়ই বা কে নেবে। এখনও আইনগত জটিলতায় কারাগারে থেকে তার শিক্ষাজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ভবিষ্যৎ প্রতিবন্ধকতার দায়ভার কে নেবে। একটি ‘আত্মহত্যা’ আর কতজন মানুষকে এভাবে ভোগাতে পারে।

ফারদিনের বাবার দুঃখের জন্য বুশরার বাবা কেন দুঃখ বয়ে বেড়াবেন, ‘সিটি শাহীনে’র স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কে ভাববে। যে ডাক্তার ময়নাতদন্ত করে হত্যাকাণ্ডের নিশ্চয়তা দিলেন এই ‘আত্মহত্যা’র রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা কতটা আস্থা নিয়ে ভবিষ্যৎ ময়নাতদন্তের ওপর আস্থা রাখতে পারবো।

এত এত প্রযুক্তির সহায়তা পেয়ে, গণমাধ্যমের এত সংবাদ প্রতিবেদনে আমাদের আস্থাশীলতা কীভাবে ফিরে আসবে।

নারায়ণগঞ্জের সম্প্রতি একটি ঘটনায় দেখেছিলাম হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন তিন কথিত ‘হত্যাকারী’। অথচ ‘হত্যার শিকার’ নারী তিন মাস পরে নিজে থানায় এসে হাজির হন। না হলে হয়তো তাদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতনের মুখে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল তা নির্দ্বিধায় ফাঁসির মঞ্চেও নিয়ে যেতো। কে বা কারা সেই জবানবন্দি নিয়েছিল, তাদেরই বা কী শাস্তি হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।

অনেক জাহালমরা হয়তো এখনও জেলের ঘানি টানছেন স্বচ্ছ বিচার না পেয়ে অথবা অন্যের ‘সাজানো নাটকে’র বলি হয়ে। বিচারাধীন একটি মামলার দণ্ড যেন আমরাই প্রতিদিন দিয়ে যাচ্ছি নিজেদের মতো করে।

সমাজ, মিডিয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা আইন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কারা আমাদের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেবেন– সেটা জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনেক চাপা পড়ে যাওয়া ঘটনা যেমন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে, আবার একই সঙ্গে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপে পড়ে অনেক ব্যক্তি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও প্রভাবিত হচ্ছে। তাই গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মামলা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সাধারণ মানুষেরও আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অপরিহার্য। না হলে এই সাধারণ মানুষই ভুক্তভোগী হবে কিন্তু সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী সে প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে না।

লেখক: কলামিস্ট ও নাট্যকার।

e-mail: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ