X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হিরো আলম এমপি হতে না পারার লজ্জা কার?

রুমিন ফারহানা
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:০৫আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:০৫

কেউ তাকে নিয়ে হাসে, কেউ ট্রল করে, কেউ বা মনে করে তাকে নিয়ে তথাকথিত ভদ্র সমাজে আলোচনাই চলতে পারে না। তারপরও আলোচনায় থাকেন তিনি, থাকেন অনেকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। কখনও ভুল সুরে রবীন্দ্র বা নজরুল সঙ্গীত গেয়ে, কখনও ভুল পোশাকে পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে, কখনও শিল্পী সমিতির সদস্য হতে গিয়ে, কখনোবা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। বলছি হিরো আলমের কথা।

একেবারে অজপাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত, দরিদ্র, অতি খর্বকায়, সারা শরীরে দীর্ঘকালীন অপুষ্টির ছাপ থাকা, শুদ্ধ প্রমিত বাংলায় কথা বলতে না পারা মানুষটিকে সহজভাবে নেওয়া আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত, ভদ্র সমাজের অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তাই পদে পদে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে তাকে।

একবার ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাকে। তার অপরাধ গুরুতর। ভুল সুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া, কন্সটেবলের পোশাক পরে ডিআইজি-এসপির ভূমিকায় অভিনয় করা। সেখানে তিনি এই মর্মে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন যে ভবিষ্যতে তিনি চলচ্চিত্র বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমেডি, গান, ভাষার বিকৃতি, বা মানহানিকর কনটেন্ট তৈরি থেকে বিরত থাকবেন। পুলিশকে মুচলেকা দেওয়ার পর বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হিরো আলম জানান পুলিশ তাকে বলেছে এই চেহারা নিয়ে কীভাবে নামের সঙ্গে হিরো যোগ করলেন তিনি।

পুলিশ এটাও জানতে চেয়েছে তিনি হিরো শব্দের অর্থ জানেন কিনা। বলা হয়েছে তিনি যদি এই শব্দের অর্থ জানতেন তাহলে নাকি এই চেহারা আর বাচনভঙ্গি নিয়ে নিজেকে হিরো দাবি করতেন না।  

এখানেই শেষ না। শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়েও আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। নিজের খরচে পাঁচটি সিনেমা নির্মাণ এবং মূল চরিত্রে অভিনয় করার পরও তাকে শিল্পী সমিতির সদস্য করা হয়নি। যদিও সদস্য হবার ন্যূনতম যে শর্ত (কমপক্ষে ৫ টি সিনেমায় উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করা) তা পূরণ করেছিলেন তিনি। মূল ধারার মিডিয়ার রিপোর্টে এসেছে শিল্পী সমিতি নির্বাচনের আগে যখনই এফডিসিতে গেছেন তিনি, তখনই বহু মানুষ ঘিরে ধরেছে তাকে। মানুষের তার প্রতি এই ভালোবাসা এবং আগ্রহকে এক পরিচালক ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, হিরো আলম ‘বানর’ এবং যেহেতু তিনি খেলা দেখাবেন, তাই তার পেছনে ঘোরে মানুষ।

কেবল ডিবি পুলিশ বা সিনেমার পরিচালকই নন, ২০১৮ সালে যখন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি তখন প্রাথমিকভাবে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। পরে হাইকোর্ট থেকে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি। সে সময় তার এই হাইকোর্ট যাওয়াকে কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব। এক প্রেস ব্রিফিং তিনি বলেন, ‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়। সেও বলে “নির্বাচন কমিশনকে আমরা হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়ছি” বোঝেন অবস্থা’। নির্বাচন কমিশন সচিব ভুলেই গিয়েছিলেন স্বাধীন দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক হিসাবে হিরো আলমের পূর্ণ অধিকার আছে যদি তিনি নিজেকে অধিকার বঞ্চিত মনে করেন, তাহলে তিনি আদালতের দারস্থ হতে পারেন। যে কাউকে হাইকোর্ট দেখাবার শতভাগ অধিকার হিরো আলমের আছে। এলিটিজম আর কলনিয়াল হ্যাংওভারে থাকা আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র সমাজ ভুলেই যান বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রতিটি নাগরিক সমান এবং সমান অধিকার লাভের অধিকারী।  

আবারও আলোচনায় এসেছেন হিরো আলম। কিন্তু এবার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি আমরা। এবার আর ট্রল বা হাসাহাসি নয়। মানুষের চোখে স্পষ্ট হচ্ছে হিরো আলমের লড়াই, স্পষ্ট হচ্ছে তার অদম্য মনোবল আর কিছুতেই হার না মানা চরিত্র। কয়েক দিন আগে বিএনপির পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া আসনের উপনির্বাচনে হিরো আলম বগুড়ার দুইটি আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে নির্বাচন শুরুর পর পরই বগুড়া ৬ আসনে তার এজেন্ট বের করে দেওয়াসহ নানা রকম প্রকাশ্য অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগ করেন তিনি, তবে ওপর আসনটিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে এবং সেখানে তিনি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন বলে জানান। এই দুই আসনের নির্বাচনি পরিবেশের ভিন্নতার ব্যাখ্যা দেবে এই তথ্যটি – বগুড়া ৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলেও বগুড়া ৪ আসনটি আওয়ামী লীগ তার শরিক জাসদকে ছেড়ে দেয়। সুতরাং ৬ আসনে ভোট ডাকাতির যে মহোৎসব হয়েছে ৪ আসনে সেটি দেখা যায়নি।   

তবে নির্বাচনে ডাকাতি না হলেও হিরো আলম দাবি করেন ফলাফলে ডাকাতি করা হয়েছে।  নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বগুড়া ৪ আসনে হিরো আলম মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তিনি দাবি করেন ভোটগ্রহণ ঠিক থাকলেও ফলাফল হিসাবের সময় কারচুপি করে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে হারিয়ে দেবার কারণ সম্পর্কে দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কিছু শিক্ষিত সমাজের লোক আছেন, যারা কিনা আমাকে মেনে নিতে চান না। তারা মনে করেন, আমি সংসদ সদস্য হলে বাংলাদেশের সম্মান থাকবে না, তাঁদের সম্মান যাবে। তথাকথিত এই শিক্ষিতরা মনে করেন, অশিক্ষিত, মূর্খকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে হবে। এতেই তাঁদের আপত্তি। তাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না, শুধু এ কারণেই নির্বাচনি ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে’।

প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেন ঠিক কী করে হারানো হয় তাকে। তিনি বলেন  ‘কেন্দ্রের ফলাফল নির্বাচনি এজেন্টদের কাছে সরবরাহ করার কথা থাকলেও বেশ কিছু কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের কাছে ফলাফল সরবরাহ করা হয়নি। আবার নন্দীগ্রাম উপজেলায় স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফলাফল ঘোষণার সময় ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১ থেকে ৩৯টি কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা করা হয়। একতারার বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হঠাৎ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়। কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর ১০ কেন্দ্রের ফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা না করে হঠাৎ জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের মশাল প্রতীকে বেশি ভোট দেখিয়ে বিজয়ী করা হয়। ১০ কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণার কারণ কী? একটি কেন্দ্রে মশাল প্রতীকে ভোট পড়েছে ২৮, অথচ গণনার সময় বেশি ভোট দেখানো হয়েছে। আরেকটি কেন্দ্রে একতারায় ৩০৭ ভোট পড়েছে, গণনার সময় ৭ ভোট দেখানো হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের ডেকেছি। সব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করব।’

হিরো আলমের এই পরাজয়ে অনেকেই স্বস্তি পেয়েছে সন্দেহ নেই। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা আবার নিজেদের ‘কালচার্ড’ বলে দাবি করেন তাদের জন্য এই হার বিরাট স্বস্তির বিষয় সন্দেহ নেই। এই ফলাফল ঘোষণার পরপর একটা অনলাইন টকশোতে শুনলাম পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বলছেন হিরো আলমকে নিয়ে কথা বলতে নাকি তার রুচিতে বাঁধে। এ এক অদ্ভুত সমাজে আমাদের বাস। এখানে ব্যাংক লুটেরা, টাকা পাচারকারি, ঘুষখোরকে সাংসদ হিসাবে মানতে আমাদের কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু নিজের যোগ্যতায় শূন্য থেকে উঠে আসা হিরো আলম সংসদে যাবেন, সেই অনেকেই মানতে নারাজ। সংসদে আমার সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনও বিল, বাজেট কিংবা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পর্যাপ্ত রিসার্চ করে সত্যিকারের একজন সাংসদ হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল একেবারেই হাতে গোনা কয়েক জন সাংসদের মধ্যে। বেশিরভাগই আবোল তাবোল বলে স্তুতি-স্তাবক করে সময় পার করেছেন যেনতেন প্রকারে। সংসদে এমনও সাংসদ আছেন, যারা এই পুরো সময়ে এক বারের জন্যও মুখ খোলেননি।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে দেউলিয়া কিংবা অপ্রকৃতিস্থ না হলে, কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন না করলে কিংবা কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার না করলে এবং নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত না হলে কমপক্ষে ২৫ বছর বয়সী যে কোনও বাংলাদেশি নাগরিক সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচন করার যোগ্য হবেন। এই সব শর্ত বিবেচনায় হিরো আলমের প্রার্থী হতে কোনও রকম কোনও বাঁধা নেই। যারা মনে করেন একটি বিশেষ শ্রেণির বাইরে আর কারো সংসদে যাওয়া বারণ তাদের উচিত হবে সংবিধান সংশোধনের দাবি তোলা।

আমি জানি না সত্যি ‘স্যার’ সম্বোধনের ভয়ে হিরো আলমকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হারানো হয়েছে কিনা। যদি সেটি সত্য হয়ে থাকে তাহলে আশা রাখি ফল পরিবর্তিত হবে। তবে সে পর্যন্ত কেবল একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই, তা হলো, একজন নাগরিক (যার রাষ্ট্রের মালিকানা প্রধামন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির চাইতে এক বিন্দুও কম না) জনগণের ম্যান্ডেট পাবার পরও সংসদ সদস্য না হতে পারা পুরো জাতির জন্যই ভীষণ লজ্জার।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। প্রকাশক ও সম্পাদক, ইত্তেহাদ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ