X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

হিরো আলম কাদের হিরো?

প্রভাষ আমিন
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:২০আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:২০

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম হিরো আলম। অবশ্য ২০১৬ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই হিরো আলম নানাভাবে আলোচনার কেন্দ্রে থাকছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতেও তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, একটা সময় গুগল সার্চে সালমান খানের পরই সবচেয়ে বেশিবার খোঁজা হয়েছে হিরো আলমকে। তারপর থেকে হিরো আলম সবসময় কমবেশি আলোচনায় ছিলেন। এবার নির্বাচনে হেরে গিয়ে আবার আলোচনার তুঙ্গে উঠেছেন।

এই আলোচনায় থাকাটাই তার কৌশল, এটাই তার ইউনিক সেলিং পয়েন্ট-ইউএসপি। এই ইউএসপি দিয়েই গ্রামের হতদরিদ্র আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম আজ কোটিপতি। গত ৫-৬ বছর ধরে ফলো করে দেখেছি, হিরো আলমকে নিয়ে সবাই হাসি-তামাশা করে, মজা করে, ট্রল করে। অনেকে বলেন, হিরো আলম এত ট্রল সহ্য করেন কীভাবে। আসলে হিরো আলম চান সবাই তাকে নিয়ে আলোচনা করুক, ট্রল করুক। যত ট্রল, তত টাকা।

আশরাফুল আলম বগুড়ার এক গ্রামের ছেলে। পেটের টানে প্রথমে সিডি বিক্রি করতেন। তারপর ডিশ ব্যবসায় নেমে পরিচিতি পান ‘ডিশ আলম’ নামে। তবে তার ইচ্ছা ছিল হিরো হওয়ার। গ্রামের ছেলে কীভাবে হিরো হবেন। তারচেয়ে বড় কথা তার উচ্চারণ, শারীরিক গঠন, চেহারা- কোনোটাই হিরো হওয়ার মতো নয়। কিন্তু মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, এই মন্ত্র জপে ‘ডিশ আলম’ হিরো হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। স্থানীয় মেয়েদের হিরোইন বানিয়ে নিজে হিরো সেজে একের পর এক মিউজিক ভিডিও বানাতে থাকেন তিনি। সেগুলো সম্প্রচার করেন নিজের ডিশ নেটওয়ার্কে। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন ‘হিরো আলম’। শ’ পাঁচেক মিউজিক ভিডিও বানানোর পর নজরে পড়েন অনেকের, ভাইরাল হয়ে যান। তারপর থেকে শুধু হিরো আলমের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। তিনি নিজে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা প্রযোজনা করেছেন, পরিচালনা করেছেন, অভিনয় করেছেন, তিনি মিউজিক ভিডিও বানিয়েছেন, বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন, নজরুলগীতি গেয়েছেন, আবৃত্তি করেছেন, এমনকি বইও লিখেছেন। শিল্প-সাহিত্যের কোনও শাখাই বাদ রাখেননি। রীতিমতো সব্যসাচী প্রতিভা!

হিরো আলমের এই শিল্প-সাহিত্য চর্চায় চারদিকে গেলো গেলো রব উঠেছে। শহুরে মধ্যবিত্তের অভিযোগ, হিরো আলম শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে দূষিত করছেন, ধ্বংস করছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মান সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে বিশ্বে। এই অভিযোগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। হিরো আলম আমার রুচির সঙ্গে যায় না। কৌতূহলে শুরুর দিকে দুয়েকটা দেখলেও এখন আমি হিরো আলমের কোনও কন্টেন্ট দেখি না। আমার রুচির সঙ্গে মেলে না বলে আমি তার কন্টেন্ট যেমন দেখি না, তাকে নিয়ে ট্রলও করি না। সত্যি বলতে, এই প্রথম আমি হিরো আলমকে নিয়ে কিছু লিখছি। আপনারা যারা হিরো আলমকে নিয়ে ট্রল করছেন, তার ভুল সুরে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার প্রতিবাদ করছেন, তাকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছেন; তারা নিশ্চয়ই তার গাওয়া শুনেছেন, কন্টেন্ট দেখেছেন। এই যে দেখেছেন, এটাই হিরো আলমের লাভ।

ছাত্রলীগ যেমন পেটাতে পেটাতে নুরুল হক নুরকে নেতা বানিয়েছে, সুশীল সমাজও তেমন ট্রল করতে করতে হিরো আলমকে সত্যিকারের হিরো বানিয়েছে।

হিরো আলম নতুন করে আলোচনায় এসেছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার দুটি আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে। নির্বাচনের সময়েই তিনি বলে দিয়েছিলেন বগুড়া-৬ আসন শেষ। আশা ছিল বগুড়া-৪ আসনে জিতবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি। মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন। হিরো আলমের দাবি, বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচন ভালো হলেও তার ফলাফল ছিনতাই করা হয়েছে। তার দাবি, একটি মহল তাকে জিততে দিতে চায় না। তবে অদম্য হিরো আলম নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছেন, প্রয়োজনে হাইকোর্টে যাবেন। নির্বাচনে অংশ নিতেও অবশ্য তাকে হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতেও তাকে  হাইকোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। সেবার নির্বাচনের মাঠে তিনি মার খেয়েছেন, কিন্তু মাঠ ছাড়েননি। এবারও তিনি মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। ২০১৮ সালের মতো এবারও তিনি নির্বাচনি অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। ওবায়দুল কাদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।

আমরা যতই অবহেলা করি, তাচ্ছিল্য করি, ট্রল; হিরো আলম হয়ে উঠছেন গ্রামের মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ।

হিরো আলম এখন আমাদের সমাজ বাস্তবতার এক অনিবার্য প্রবণতা। তাকে আপনি পছন্দ করতে পারেন, অপছন্দ করতে পারেন; কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আর রাখেননি তিনি। হিরো আলম এখন মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছেন। তাকে গেলাও যাচ্ছে না, ফেলাও যাচ্ছে না। একবার পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে ভুল সুরে রবীন্দ্রসংগীত-নজরুলগীতি না গাওয়ার মুচলেকা নিয়েছে। পুলিশের পোশাক পরে অভিনয় না করার অঙ্গীকার আদায় করেছে। যেন হিরো আলমের আগে কেউ ভুল সুরে রবীন্দ্রনাথের গান করেনি। যেন পুলিশের পোশাক পরে অভিনয় করেনি। পুলিশ হিরো আলমকে ঠেকাতে গিয়ে উল্টো এগিয়ে দিয়েছে। পুলিশ হিরো আলমের সঙ্গে যা করেছে তা অন্যায়। একজন নাগরিকের মানবিক মর্যাদার ওপর আঘাত করেছে, তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। হিরো আলমকে পুলিশি তলবের পর বিবিসি তাকে নিয়ে বিশাল রিপোর্ট করেছে। এখন গুগল সার্চে ‘হিরো’ লিখলেই হিরো আলমের হাজার হাজার কন্টেন্ট চলে আসে। কীভাবে আপনি তাকে ঠেকাবেন? তারচেয়ে বড় কথা, ঠেকাতে হবে কেন। হিরো যতক্ষণ বেআইনি কিছু না করছেন, ততক্ষণ তাকে ঠেকানোর সুযোগ নেই। আমি দেখবো না, তাকে নিয়ে ট্রল করবো না; এটুকুই আমার করণীয়। এর বেশি কিছু করার আইনি অধিকার আমার নেই। সংবিধান হিরো আলমকে তার মতপ্রকাশের, ভাবপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে।

আগেই বলেছি, হিরো আলমের রুচির সঙ্গে আমার রুচি মেলে না। আমি বড় হয়েছি পঞ্চকবির গান শুনে; মান্না, হেমন্ত, ভুপেন, মানবেন্দ্র, কিশোর, লতা, আশা, রুনা, সাবিনা, শাহনাজ, মাহমুদুন্নবী, খুরশিদ আলম শুনে। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, হুমায়ূন পড়ে। সিনেমার পৃথিবীও বড় জোর হিন্দি সিনেমা পর্যন্ত। আমি নিশ্চিত হিরো আলম এর কোনোটাই পড়েননি বা শোনেননি। তাতে কি হিরো আলম নিম্ন রুচির হয়ে গেলেন, আর আমি অনেক উচ্চ রুচির? আমাদের সমসাময়িক অনেকের সঙ্গেও তো আমার রুচি মেলে না।

আমাদের ব্যাচের অনেকেই তো কাশেম বিন আবু বকর বা মুজিব পরদেশীর বেশি পড়েননি বা শোনেননি। আমরা যেমন তাদের নিয়ে নাক সিটকাই, আবার আমাদের বন্ধুদের অনেকে বব ডিলান, জন লেনন, জিম মরিসন, বব মারলের গান শুনে বড় হয়েছেন। তারা ইংরেজি গান, কবিতা, সাহিত্য পড়েছেন। রবীন্দ্রসংগীতের ‘প্যানপ্যানানি’ শুনি বলে তারাও কিন্তু আমাদের নিয়ে নাক সিটকায়। আমার বন্ধুদের যারা বোর্হেস, মার্কেজ পড়েছেন; তাদের তুলনায় আমরা কিন্তু মূর্খ।

যদি আপনি সত্যি সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা চান, তাহলে আপনাকে গ্রামে যেতে হবে। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। গণমানুষের রুচি গঠনে গণমাধ্যমকে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমও যদি সামাজিক মাধ্যমের ভাইরালের পেছনে ছোটে, তাহলে হিরো আলমরা আরও বিস্তৃত হবে।

আসলে রুচি বিষয়টাই আপেক্ষিক, এর কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, নির্দিষ্ট সীমা নেই। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে পঞ্চকবির গান শুনলেই সংস্কৃতি উদ্ধার হয় না। গ্রামের কোটি কোটি মানুষ, বেঙ্গলে যাদের প্রবেশাধিকার নেই, তাদের বিনোদন তবে কী? একসময় গ্রামে যাত্রাপালা ছিল, কবি গান ছিল, পালা গান ছিল। বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার সুর ভেসে বেড়াতো গ্রামের বাতাসে। এখন তো ওয়াজ ছাড়া কোনও বিনোদন নেই। হিরো আলম সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন। আমরা যতই ট্রল করি, হিরো আলম সেই প্রান্তিক মানুষদের কাছে সত্যিকারের হিরো।

 
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ