X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে রাজনীতি

প্রভাষ আমিন
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪২আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪২

তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন কার্যত গৃহবন্দি। দুর্নীতির দুটি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন। প্রথমে তাকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হলেও একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়। তারপর থেকে তিনি গুলশানের ভাড়া বাসায় থাকছেন। কয়েকবার চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া প্রায় তিন বছর সময়ে বেগম জিয়া বাসা থেকে বের হননি। পরিবারের সদস্য, ডাক্তার এবং দলের নির্ধারিত কয়েকজন সিনিয়র নেতা ছাড়া আর কেউ তার বাসায় যাননি। এই পরিস্থিতিকে গৃহবন্দিত্ব বলাই সঙ্গত।

সরকার দুটি শর্তে তাকে মুক্তি দিয়েছিল– তাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। এর বাইরে অলিখিত কোনও শর্ত ছিল কিনা, তা জানা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দেওয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে খালেদা জিয়াকে বাসায় নেওয়া হয়েছে।’

বিএনপি নেতারা তার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানালেও আওয়ামী লীগের আর কোনও নেতা শেখ সেলিমের বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলেননি। কিন্তু এখন সরকারি দলের নেতারা বলছেন, শর্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই। আইনমন্ত্রী প্রথম বিতর্কটি তোলেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না। তবে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন কোনও কথা শর্তে ছিল না। তিনি একজন মুক্ত মানুষ, তিনি কী করবেন, সেটা তার ইচ্ছা। পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই বলে মত দেন।

নির্বাহী আদেশে মুক্তির প্রায় তিন বছর পর খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে এই বিতর্কে এখন রাজনীতিতে তোলপাড়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তারপর থেকেই খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে দূরে। নির্বাহী আদেশে মুক্তির পরও এ অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। খালেদা জিয়া কার্যত অবসর জীবনযাপন করছেন। শেখ সেলিমের বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেও ‘খালেদা জিয়া রাজনীতি না করার মুচলেকা দেননি’- এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়াও রাজনীতিতে ফিরে আসেননি, দল থেকেও তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শেখ সেলিমের বক্তব্য সত্য হলে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না। আর আইনমন্ত্রীর কথা সত্য হলে তার রাজনীতি করতে বাধা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিন বছর পর কেন আইনমন্ত্রীর খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তের কথা মনে পড়লো। মুক্তির সময়ই তো তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারতেন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, সরকারের এই অবস্থান, বিএনপির লুফে নেওয়ার কথা। কিন্তু সরকারের এই অবস্থান নিয়ে সংশয়ে আছে বিএনপি। তারা সরকারকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। অবশ্য বিশ্বাস করার কারণও নেই। গত একযুগে সরকার বিএনপির সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তাতে সরকারের আপাত উদারতাকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখছে। তবে সরকারের সিনিয়র নেতারা একযোগে খালেদা জিয়াকে রাজনীতির মাঠে নামানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছেন কেন, সরকার কেন এত ভালো হয়ে গেছে, সন্দেহ সেটা নিয়েই। এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাপনী বিভাগীয় সমাবেশের আগে বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের কেউ কেউ বলেছিলেন, সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারা অবশ্য এটা অস্বীকার করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা তখন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তখন বলেছিলেন, বিএনপির গণসমাবেশে খালেদা জিয়ার যাওয়া না-যাওয়ার আলোচনা অবাস্তব, উদ্ভট ও অলীক চিন্তা। খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আদালত থেকে জামিন পাননি। এখন যদি বিএনপি নেতারা এ রকম চিন্তা করে থাকেন; তাহলে সরকার খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠাতে বাধ্য হবে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেছিলেন, খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে আছেন এবং তিনি জনসভায় যোগ দিলে আদালত ব্যবস্থা নেবেন।

দুই মাসের মধ্যে কেন সরকার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন? এই প্রশ্নের জবাবেই লুকিয়ে আছে রাজনীতির আগামী দিনের গতিপথ। আমার ধারণা বেগম খালেদা জিয়াই আগামী নির্বাচনের আগে সরকারের ট্রাম্পকার্ড। আইনমন্ত্রী যেটা বলছেন, সেটা কিন্তু স্পষ্ট। খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে রাজনীতি করা না করার বিষয়ে কিছু বলা নেই। তারচেয়ে বড় কথা, নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে রাজনীতি করার উদাহরণ এই বাংলাদেশেই আছে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাসদের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের শাস্তিও নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হয়েছিল। তিনি শাস্তির স্থগিতাদেশ নিয়েই চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি রাজনীতিও করেছেন।

এখন দেখার বিষয়, সরকারের এই নতুন অবস্থানের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বিএনপিতে এবং রাজনীতিতে।

প্রথমত, দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে নেতারা প্রবল চাপের মুখে পড়বেন। কারণ, খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রবল আবেগ রয়েছে। সরকার বলছে, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন, তারপরও নেতারা কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না, এটা নেতারা কর্মীদের বোঝাতে পারবেন না।

দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। লন্ডনে বসেই তিনি দল পরিচালনা করছেন। বিএনপিতে এখন কার্যত তারেক রহমানের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া যদি রাজনীতিতে সক্রিয় হন, চেয়ারম্যান পদে ফিরে যান, তাহলে কার্যত তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণ ক্ষুণ্ন হবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রতি আনুগত্য নিরঙ্কুশ হলেও তারেক রহমানের প্রতি ততটা নয়। বিএনপির অনেকেই তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না। তাই খালেদা জিয়ার ফিরে আসাটা দলের শীর্ষ নেতৃত্বে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়াবে।

তৃতীয়ত, আমার ধারণা খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফিরে আসাটাকে সরকার বিএনপির আগামী নির্বাচনের আসার টোপ হিসেবে ব্যবহার করবেন। বিএনপি যদি বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে যেতে রাজি হয়, তাহলে হয়তো খালেদা জিয়া নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পারবেন। দণ্ডিত হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী খালেদা জিয়া যেহেতু রাজনীতি করতে পারবেন না, তাই তাকে মাঠে নামার সুযোগ দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারাটা সরকারের জন্য বিশাল বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে।

চতুর্থত, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে এলো না। তাহলে কী হবে? সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। মুক্তির শর্তে রাজনীতি করা না করার কথা নেই বটে। কিন্তু তারপরও খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নামলে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ আনা সম্ভব। আইনমন্ত্রীর কথাতেই লুকিয়ে আছে তার ব্যাখ্যা, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় যে চিঠি লেখা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ওনার শারীরিক অবস্থা এমন, সুচিকিৎসা না হলে তাঁর জীবন বিপন্ন হবে। আপনারাই বিচার করেন, যিনি অসুস্থ, তিনি কি রাজনীতি করতে পারেন? যদি আপনাদের (সাংবাদিকদের) বিবেচনায় মনে হয় তিনি রাজনীতি করতে পারেন, তাহলে আপনাদের বিবেচনা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এটাই মনে হচ্ছে বেস্ট জাজমেন্ট।’

বিএনপি যদি সরকারের কথামতো চলে, নির্বাচনে যায়; তাহলে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পরের অংশটা সরকার এড়িয়ে যেতে পারবে। আর যদি বিএনপি সরকারের কথা না মানে তাহলে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পরের অংশটা ধরে সরকার খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে ফেরত পাঠাতে পারবে। খালেদা জিয়া অসুস্থ বলে পরিবারের আবেদনে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ছয় মাস পরপর আবার আবেদনে মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু তিনি যদি রাজনীতি করার মতো সুস্থ হয়ে যান, তাহলে সরকার তাকে আর মুক্ত রাখার দরকার নাও মনে করতে পারে।

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, সরকারের এই অবস্থান বিএনপিকে গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছে। সরকার বারবার বলার পরও যদি বিএনপি খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সক্রিয় না করে, সেটাও তাদের জন্য চাপের হবে। আবার যদি খালেদা জিয়া মাঠে নামেন তাহলে ঘটতে পারে অনেক কিছু। খালেদা জিয়া মাঠে না নামলে সরকারি দলের নেতারা তখন বলতে পারবেন, আমরা বাধা দিচ্ছি না, তারপরও বিএনপি খালেদা জিয়াকে মাঠে নামতে দিচ্ছে না। তার মানে তারেক রহমানের বিএনপি চায় না খালেদা জিয়া রাজনীতি করুন। এই উভয় সংকট বিএনপি কীভাবে সামলায়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ