X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছোটদের ফলাফল নিয়ে বড়দের ছেলেমানুষি

প্রভাষ আমিন
০২ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫২আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫২

কোনও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হলে আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখি, পরদিন পত্রিকা পড়ি। সফল শিক্ষার্থীদের ঝলমলে আনন্দময় চেহারা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তাদের উদযাপন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনতে শুনতে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। টিভি আর পত্রিকার সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ফেসবুক। পরীক্ষার ফলাফল দিলেই অভিভাবকরা সন্তানের সাফল্যের খবর জানান ফেসবুকে। আমি স্ক্রল করে করে খবরগুলো দেখি। আমার মন ভরে যায়। গত মঙ্গলবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ফেসবুকজুড়ে ছিল অভিভাবকদের উল্লাস আর শিশুদের হাসিমুখ। বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন মিষ্টির দোকানে টান পড়ে যায়। সফল শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা পরিচিত ও স্বজনদের মিষ্টি খাওয়ান। ফলে মিষ্টি ফুরিয়ে যায়।

বৃত্তি পরীক্ষায় ফলাফল ঘোষণার কথায় নিজের ছেলেবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আমিও পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৮০ সালের কথা। তখন বৃত্তি পেলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ারও একটা চল ছিল। বৃত্তি পাওয়ার পর আব্বার সঙ্গে ঢাকা এসেছিলাম বেড়াতে। আব্বা আমাকে নিয়ে ইত্তেফাক অফিসে গিয়েছিলেন বৃত্তি পাওয়ার খবরের বিজ্ঞাপন দিতে। সেটাই প্রথম কোনও পত্রিকা অফিসে যাওয়া। কিন্তু বিজ্ঞাপন দিতে যে টাকা লাগে আমার স্কুলশিক্ষক বাবার জন্য সেটা অনেক বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনটা দেওয়া হয়নি। তাতে আমার অল্প মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আব্বার মন বেশি খারাপ হয়েছিল। সন্তানের সাফল্যের খবর পত্রিকায় ছাপাতে না পারার যে গ্লানি সেটাই তার মন খারাপের কারণ। তবে ইত্তেফাক অফিস দেখেছি, তাতেই আমি খুশি ছিলাম। আমার যেটুকু মন খারাপ হয়েছিল, তাও আব্বাকে বুঝতে দেইনি।

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। যথারীতি গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিল সাফল্যের উল্লাস। কিন্তু এই উল্লাসের আয়ু ছিল মাত্র ছয় ঘণ্টা। সন্ধ্যায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ফলাফল স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কারিগরি ত্রুটির জন্য প্রকাশিত ফলাফল পুনরায় যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় ফলাফল আপাতত স্থগিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে সারাক্ষণ গলা ফাটাই। ডিজিটাল থেকে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাত্রার স্লোগান দিচ্ছি। কিন্তু প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল কারিগরি ত্রুটির কারণে স্থগিত করতে হয়। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যে আনস্মার্ট, খাঁটি বাংলায় বললে ‘ক্ষ্যাত’ আচরণ করলো; এই মন্ত্রণালয় নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাটাই বৃথা।  

মঙ্গলবার ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এরমধ্যে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী আর সাধারণ কোটায় পেয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন। যারা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাসে ৩০০ টাকা আর সাধারণ কোটায় বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা মাসে ২২৫ টাকা করে পাবে। এ ছাড়া বৃত্তি পাওয়া সব শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ২২৫ টাকা করে পাবে। টাকার অঙ্কটা বড় কথা নয়। বৃত্তি পাওয়াটা এক ধরনের স্বীকৃতি, সম্মান। বৃত্তি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী করে।

মঙ্গলবার বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল স্থগিত করার সময়ই বলা হয়েছিল বুধবার ফলাফল ঘোষণা করা হবে। সেই ঘোষণা আসতে আসতে রাত সাড়ে ১০টা বেজে যায়। এই লেখা পর্যন্ত জানি না নতুন ফলাফলে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ফেসবুকে অভিভাবকদের স্ট্যাটাস সূত্রে জেনেছি, কারও কারও ফলাফল সাধারণ কোটা বদলে ট্যালেন্টপুল হয়েছে। তার মানে ফলাফলে পরিবর্তন হয়েছে। একবার ভাবুন মঙ্গলবারের ফলাফলে বৃত্তি পেয়েছিল, কিন্তু বুধবারের ফলাফলে বৃত্তি বাতিল হয়েছে; এমন একটি ঘটনাও যদি ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে। অবশ্য কিছু বৃত্তি বাতিল হবেই। কারণ, পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়ার মতো ভৌতিক ঘটনাও ঘটেছে। সেই ভৌতিক পরিস্থিতি বাদ দিয়ে বাকিদের ক্ষেত্রে বলা যায়, একজনও যদি বাদ যায়, তার দায়িত্ব কে নেবে?

যারা ছোটদের ফলাফল নিয়ে এই তুঘলকি কাণ্ডটি ঘটালেন, তারা কি একবারও ১০ বছর বয়সী শিশুদের মনের কথা ভেবেছেন। মঙ্গলবারের বৃত্তি পাওয়া কেউ যদি বুধবার বাদ পড়ে, তার মনের অবস্থা কী হবে। ট্যালেন্টপুল থেকে কেউ যদি সাধারণ কোটায় নেমে আসে, তার আত্মবিশ্বাস কোথায় যাবে। আমি ধরে নিচ্ছি, পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়া ছাড়া আর কারও বৃত্তি বাতিল হবে না। কিন্তু এই শিশুদের প্রায় ২৬ ঘণ্টা অনিশ্চয়তায় রাখার দায়িত্ব কে নেবে? যারা এখন মন্ত্রী-সচিব বা মহাপরিচালক হয়ে ইচ্ছামতো ফলাফল ঘোষণা করছেন, স্থগিত করছেন; তারা কি কখনও ক্লাস ফাইভে পড়েননি, তারা কি নিজেদের সেই বয়সের মনের অবস্থাটা ভুলে গেছেন, তাদের কি সন্তান নেই? তাহলে তারা কীভাবে বাচ্চাদের একটা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এমন ছেলেমানুষি করতে পারেন। শুধু ফলাফল নয়, এই বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে এর আগেও অনেক ছেলেখেলা হয়েছে। হুট করে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া, হুট করে তারিখ বদলে ফেলার মতো ছেলেমানুষিও হয়েছে।

পত্রিকায় দেখলাম, ফলাফল তৈরির সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কারিগরি দলের ভুলের কারণে মূলত এ ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। নতুন করে ফলাফল ঘোষণার সময় ভুলের কারণে ক্ষমাও চেয়েছে সরকার। কিন্তু এটা নিছক ভুল নয়। নিছক ক্ষমা চাওয়ায় এর দায় চুকেবুকে যাবে না। শিশুদের মনের ওপর প্রবল চাপ তৈরির এই ঘটনা রীতিমতো অপরাধ। যারা অপরাধী তাদের শাস্তি পেতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালককেও। তদন্তের নামে যেন সময়ক্ষেপণ করা না হয়। দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যারা পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন, তারা যদি দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ দায় স্বীকার করে না। সবাই দায় অন্যজনের ঘাড়ে চাপায়। তবে শিশুদের নিয়ে এই ছেলেখেলার দায় যেন কেউ এড়াতে না পারে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ