X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ভালো কাজের পুরস্কার

মাসুমা সিদ্দিকা
৩১ মার্চ ২০২৩, ১৬:১৮আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৬:১৮

শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীরা একদিন আবদার করেছিল, আমাদের হেলিকপ্টারে চড়াবেন স্যার। স্যারও সেদিন বলেছিলেন, যারা পরীক্ষায় বৃত্তি পাবে, তাদের সবাইকে হেলিকপ্টারে চড়াবেন। নিজের দেওয়া কথা ঠিকই রাখলেন স্যার, তাদের ভালো কাজের প্রতিদান দিলেন। ঘটা করে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হেলিকপ্টার ভাড়া করে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীকে হেলিকপ্টারে চড়ালেন। আমরা সহসা মানুষের ভালো কাজের প্রতিদান দিতে নারাজ। আর অনেক সময় সেটা দিলেও তা দেই অনেক দেরিতে। এমনকি অনেক সময় রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও দেওয়া হয় মরণোত্তর তা দিয়ে হয়তো স্বজনদের কোনও শ্লাঘা হতে পারে; কিন্তু পুরস্কার যিনি পান তার কোনও কাজে আসে না। এমনকি সাধারণভাবে মানুষকে ভদ্রতাসূচক উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলার ব্যাপারেও আমাদের অনেকেরই অনেক কার্পণ্য রয়েছে। আমাদের এই কথা না রাখার বা স্বীকৃতি না দেওয়ার সমাজে এই শিক্ষক একটা চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করলেন।  

মাঝে মাঝে সব ছোট বাচ্চাদের কথা বিশেষভাবে মনে নাড়া দেয় তখন চলে যাই এক ভাবনার জগতে যেখানে মনে হতে থাকে আমরা কি শিক্ষা দিচ্ছি আমাদের সন্তানকে? ওরা কি আদৌ সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সঠিক পরিবেশ পাচ্ছে? আমরা কি তাদের মানবিক গুণাবলীগুলোকে সঠিকভাবে গড়তে সাহায্য করছি নাকি এগুলোকে ধ্বংস  করতে ওঠে পড়ে লেগেছি? তাদেরকে রোবটের মদো কমান্ডে চলা নিরানন্দ একটা জীবন চর্চায় বড় করছি। এই রোবোটিক জীবনে শুধু প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড় আছে, অতি সাধারণ মানবীয় গুণাবলী চর্চার কোনও মূল্য নেই।

কয়েকদিন আগে আমার আট বছর বয়সী ছেলে আমাকে বলছিল, স্কুলে সব সময় শুধু পড়াশুনা, কোনও আনন্দ নেই।  আমি বললাম, কেন বাবা? স্কুলে তো কত বন্ধু, তাদের সাথে গল্প হয়, খেলা করতে পারো। আবার ভালো রেজাল্ট করলে পুরস্কার দেওয়া হয় স্কুল থেকে। তখন সবাই কত প্রশংসা করে; আবার খেলাধুলায় ভালো করলে পুরস্কার পাওয়া যায়, সবাই অনেক প্রশংসা করে। আমার ছেলের প্রশ্ন, “কিন্তু কোনও ভালো কাজের জন্য তো কোন পুরস্কার দেওয়া হয় না। ক্লাসের সবাই যখন দুষ্টুমি করে আমরা চুপচাপ ভদ্র হয়ে থাকি, স্যার-মিসদের কথা শুনি, একটুও দুষ্টামি করি না কিন্তু কোনও পুরস্কারও দেওয়া হয় না ভালো কোনও কাজ করলে। ভালো কাজ করলে কি তবে পুরস্কার নেই?” আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ছেলের এই কথা শুনে, কোনও সদুত্তর খুঁজে পেলাম না।

নানা রকম কড়াকড়ির ফলে স্কুল থেকে বেত বিদায় নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু সাধারণভাবে ভালো আচরণ, ভালো কাজের পুরস্কারের কোনও সংস্কৃতি আমাদের স্কুলে তেমন একটা দেখা যায় না। আমরা আমাদের বাচ্চাকে স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো কাজের জন্য, ভালো আচরণের জন্য পুরস্কার কেন দেব  না। তা না হলে ওরা ভালো আচরণ, ভালো ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে কী করে? বর্তমান যুগে অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের বিভিন্ন রকম খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন বটে, কিন্তু আমাদের মানবিক সমাজ গঠনে যে মানবিক গুণাবলীগুলো বাচ্চাদের মধ্যে বেড়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন সেগুলো তো তেমনভাবে চর্চা করা হয়ে ওঠে না। আমরা বাচ্চাদের স্বার্থপরভাবে বেড়ে ওঠতে উৎসাহ দিচ্ছি। সব সময় নিজের জিনিসপত্র, বই-খাতা, খেলনা সামগ্রীর প্রতি যত্নশীল হতে শিক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু ভালো আচরণ বা নিজের কাজ ঠিকভাবে করা এবং কাজের জন্য আপ্রিসিয়েশন শিক্ষা দিচ্ছি কি? তাই মানবিক গুণগুলো সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সঠিক পরিবেশ পাচ্ছে না। এজন্যই হয়তো আমাদের দেশে সরকারি অনেক অফিসেই একজন সেবা প্রার্থীকে ‘আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি; এর বদলে শুনতে হয়, ‘কী চাই’?

শৈশবের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা মানুষের পরবর্তী জীবনে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়– কথাটা চিরন্তন সত্য। আমরা যদি বাচ্চাদের ভালো গুণগুলো উৎসাহ না দেই তবে তারা মানবিক গুণ সম্পন্ন হওয়া কঠিন। যেকোনও মূল্যে সফল হওয়াটাই হয়ে উঠবে তাদের জীবনের পরম মন্ত্র। যে ছেলেটা অন্য সবার মতো দুষ্টুমি না করে বন্ধুকে সাহায্য করছে, চুপচাপ শিক্ষকদের কথা মতো কাজ করে যাচ্ছে, তাদের বিরক্ত করছে না তাকে যদি কিছুটা উপহার দিয়ে মুখের মিষ্টি হাসি দিয়ে পুরস্কৃত করা যায় তবে মনে হয় তারা ভালো কাজের বা আচরণের প্রতি অনেক বেশি করে আগ্রহী হবে।

যদি আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক সমাজ দেখতে চাই, তবে আমাদের সন্তানদের ভালো গুণাবলী অর্জনের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া একান্তই প্রয়োজন সেগুলো অবশ্যই নিতে হবে। তাদের অতি সাধারণ গুণগুলোকে যেমন প্রশংসা করতে হবে; তেমনি উৎসাহী করতে হবে ভালো কাজ করতে। শুধু খারাপ কাজের জন্য শাস্তি না দিয়ে, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া উচিত যেন তারা ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী হয়। সেই পুরস্কার হেলিকপ্টারের চলার মতো দুর্লভ কোনও মুহূর্ত নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা স্কুলের কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাসিমুখে বলা দুটো কথা অনেক উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে। শিশুর মনোজগতে এর একটা সুদূরপ্রসারী সুপ্রভাব পড়তে পারে।

 

লেখক: রন্ধন শিল্পী ও ফ্রিল্যান্সার

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ