X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

বাকি চার সিটিতে কী হবে?

আমীন আল রশীদ
২৮ মে ২০২৩, ১৯:১৪আপডেট : ২৮ মে ২০২৩, ১৯:১৪

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পরাজয় নিয়ে চলছে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ। সঙ্গত কারণে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে।

১. গাজীপুরে নৌকা হেরেছে নাকি ব্যক্তি আজমত উল্লা খান?

২. গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে কি সরকারবিরোধী দল শক্তিশালী বলে?

৩. বিএনপি চলমান সিটি নির্বাচন বর্জন করছে। ফলে গাজীপুরে যদি বিএনপির প্রার্থী থাকতেন, তাহলেও কি ভোটের ফলাফল এরকমই হতো?

৪. গাজীপুরে নৌকা হেরে গেছে মানে কি বাকি চার সিটিতেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পরাজয়ের শঙ্কা আছে?

৫. গাজীপুরে কেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কমুক্ত নির্বাচন হলো? নির্বাচন কমিশন সেখানে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে বলে?

৬. গাজীপুরের নির্বাচনে সরকার চাইলে কি নৌকার প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে পারতো না? সেটি কেন করলো না? দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে এবং এই যুক্তিতে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্যও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই—এই বার্তাটি দেওয়ার জন্য?

৭. সরকারের সদিচ্ছা এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতায় গাজীপুরের নির্বাচন যতটা অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হলো, বাকি চারটিতেও কি সেরকম ভোট হবে?

৮. স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কী হবে—সে বিষয়ে কোনও উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব?

এসব প্রশ্নের উত্তর এক কথায় এবং এখনই দেওয়া কঠিন। তবে আপাতত চার নম্বর প্রশ্ন, অর্থাৎ গাজীপুরে নৌকা হেরে গেছে বলে বাকি চার সিটিতেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পরাজয়ের শঙ্কা কতটুকু—সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর পাঠকরা কমবেশি জানেন। উল্লেখ্য, এই দফায় দেশের যে পাঁচটি সিটিতে নির্বাচন হবে, সেটির সূচনা হলো ঢাকার পার্শ্ববর্তী সিটি গাজীপুর দিয়ে। খুলনা ও বরিশালে ১২ জুন এবং রাজশাহী ও সিলেটে ভোট হবে ২১ জুন।

বরিশাল:

অফিসিয়ালি গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে। কিন্তু কার্যত এখানে জয়ী হয়েছে জায়েদা খাতুনের ছেলে, গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র ও বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম। অর্থাৎ এখানে লড়াই হয়েছে ব্যক্তি আজমত উল্লার সঙ্গে ব্যক্তি জাহাঙ্গীরের। এটাকে আওয়ামী লীগের গৃহদাহ বললেও ভুল হবে না।

অনেকটা কাছাকাছি সমস্যা বিরাজ করছে আরেক সিটি বরিশালে। সেখানে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ—যিনি রাজনীতিতে সেভাবে পরিচিত নন। সেখানে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। অবশ্য বিগত পাঁচ বছরে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেভাবে বিতর্কিত হয়েছেন, তাতে এবার তিনি মনোনয়ন পেলে এবং মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে হেরে যেতেন বলে নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন।

বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বরাবরই সেরনিয়াবাত পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পারিবারিক বিরোধই এখন এখানে নৌকার প্রার্থীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভাতিজা সাদিক আব্দুল্লাহর বিরোধিতা থাকলেও খায়ের আব্দুল্লাহর পাশে আছেন বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারীরা। কিন্তু তারপরও এখানে যদি গাজীপুরের মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত ভোট হয়—তাহলে দুই কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

১. এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি প্রার্থী না দিলেও এই নগরীর সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপি এই ভোট বর্জন করলেও এবং বিএনপির তরফে তাদের কর্মী সমর্থকদের ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানালেও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার ইস্যুতে বিএনপির কর্মী সমর্থকরা গোপনে রুপনের পক্ষে সক্রিয় বলে শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া বিগত পাঁচ বছরে যেসব নাগরিক বর্তমান মেয়রের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত, তারাও প্রতিশোধ হিসেবে রুপনকে ভোট দিতে পারেন।

২. বরিশালে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক অবস্থা বেশ শক্তিশালী। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘সমঝোতা’র অংশ হিসেবে এখানে সরকার ছাড় দিতে পারে। বিশেষ করে বরিশালে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও চরমোনাই পীরের ছেলে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমকে প্রার্থী করায় এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বরিশাল সদর আসনে ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। সুতরাং বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির বাইরে প্রথমবারের মতো অন্য কোনও দলের প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হলেও সেটি অস্বাভাবিক হবে না বলে অনেকেই মনে করেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বরিশালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয় সুনিশ্চিত এ কথা বলার সুযোগ নেই। বরং তার জন্য চ্যালেঞ্জ অনেকগুলো।

সিলেট:

সিলেটের সবশেষ মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে এবার ভোটের মাঠে নেই। তিনি শুধু দলীয় প্রতীক নয়, বরং স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও জয়ী হতেন—সে বিষয়ে সন্দেহ কম। কারণ সিলেটে তিনি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আরিফুল হক চৌধুরী মাঠে নেই বলে এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্ভাবনায় জিতে যাবেন—বিষয়টা এত সহজ নয়। এখানেও দলীয় কোন্দল আছে। কেননা, সিলেটে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী—যাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরাট অংশের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না বলে গণমাধ্যমের খবরেও বলা হচ্ছে। এখানে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ আবদুল হানিফও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সংগত কারণেই এখানে আওয়ামী লীগের অনেক ভোট তিনি পাবেন। যেহেতু নৌকার প্রতীক পাওয়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে সিলেটের আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ নয়, ফলে এই সুযোগ স্বতন্ত্র কিংবা অন্য কোনও দলের প্রার্থী পেতে পারেন—এমনটিও অনেকে মনে করেন। সিলেটে মেয়র পদে আরও মাঠে আছেন জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল, ইসলামী আন্দোলনের মাহমুদুল হাসান, জাকের পার্টির প্রার্থী মো. জহিরুল আলম এবং আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছালাহ উদ্দিন রিমন। এখানে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতাকর্মী, সমর্থক এবং বিএনপির ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন—তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে নৌকার প্রার্থী জিতে যাবেন।

রাজশাহী ও খুলনা:

রাজশাহীর ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় যে সেখানে বিদায়ী মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনই জয়ী হবেন। প্রথমত তিনি রাজশাহী সিটিতে বেশ জনপ্রিয়। প্রচুর উন্নয়নমূলক ও জনবান্ধব কাজ করেছেন। রাজশাহীকে একটি সবুজ ও পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছেন। উপরন্তু এখানে তার কোনও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। ফলে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটলে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী লিটন জয়ী হবেন—সে বিষয়ে সংশয় কম।

খুলনা সিটি করপোরেশনে সদ্য বিদায়ী মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আব্দুল খালেকের বিজয়ী হওয়ার পথে চ্যালেঞ্জ বা অন্তরায় কম। নির্বাচন বর্জন করায় এখানে বিএনপির কোনও প্রার্থী নেই। মেয়র পদে অন্য যারা মাঠে আছেন, তাদের কেউই স্থানীয় রাজনীতিতে আব্দুল খালেকের সমকক্ষ নন। অর্থাৎ তার কোনও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যদিও ইসলামী আন্দোলনের দাবি, এবার বিএনপির প্রার্থী না থাকায় গত নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে থাকা তাদের দল এগিয়ে থাকবে। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তালুকদার খালেক যেখানে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু পান ১ লাখ ৯ হাজার ২৫১ ভোট, সেখানে ইসলামী আন্দোলনের মুজ্জাম্মিল হক পেয়েছিলেন ১৪ হাজার ৩৬৩ ভোট। অর্থাৎ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তৃতীয় স্থানে থাকা প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল প্রায় ৯৫ হাজার। সুতরাং এবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ খুলনায় তাদের ফেবারিট দাবি করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। সব মিলিয়ে এখানে নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হবে বিরাট দুর্ঘটনা।

ইভিএম অভিজ্ঞতা:

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো দিক, ২৫ মে দিনভর এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় কোনও অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে আসেনি। দ্বিতীয়ত, বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় প্রার্থীই বলেছেন ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানও পরাজয় মেনে নিয়ে বলেছেন, কেউ সহযোগিতা চাইলে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ তিনি নবনির্বাচিত মেয়রকেই উদ্দেশ করে বলেছেন, নগরীর উন্নয়নে তিনি যদি সহযোগিতা চান তাহলে সেই সহযোগিতা দিতে তিনি প্রস্তুত।

তবে গাজীপুরে ইভিএমে ভোট হলেও ফলাফল ঘোষণায় দীর্ঘ সময় লাগে। দিনভর ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ পাওয়া যায় এবং ফলাফল ঘোষণাও হয় ধীরে ধীরে। ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব দেখে কেউ কেউ ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে বলেও সন্দেহ করতে থাকেন। অথচ নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের তরফে বরাবরই বলা হয়েছে, ইভিএমে ভোটগ্রহণ এবং ফলাফল ঘোষণা ব্যালট বাক্সের চেয়ে দ্রুত করা সম্ভব। কিন্তু গাজীপুরের অভিজ্ঞতা সেটি বলছে না। সুতরাং আরও যে চারটি সিটিতে ভোট হবে, সেখানেও যেহেতু শতভাগ কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া হবে, ফলে ইসিকে গাজীপুরের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
তিনি এখন হলিউডের শীর্ষ কাঙ্ক্ষিত ব্যাচেলর!
তিনি এখন হলিউডের শীর্ষ কাঙ্ক্ষিত ব্যাচেলর!
সর্বশেষসর্বাধিক