X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর ক্ষমতায়ন এবং মজুরি বৈষম্য

প্রণব মজুমদার
১৫ জুন ২০২৩, ১৭:৫৬আপডেট : ১৫ জুন ২০২৩, ১৭:৫৬

আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবদানকে ছোট করে দেখা হয়। তাই প্রায় সব সময়ই তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হন। বেসরকারি সংস্থা অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে গত ১ দশকে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে বেড়েছে। যার ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের অধিকাংশই মজুরি বৈষম্যের শিকার। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভলপমেন্টের যৌথ এক গবেষণাপত্র ‘নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ন্যায্যতা’ থেকে জানা যায়, ৬১ শতাংশ নারী শ্রমিক দৈনিক ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন। রাজধানীতে গৃহকর্মীর কাজের জন্য যেখানে একজন নারী শ্রমিককে পারিশ্রমিক হিসেবে ৩৫০০-৪০০০ টাকা দেওয়া হয়; সেখানে একজন পুরুষ কেয়ারটেকারকে দেওয়া হয় ৬০০০-৭০০০ টাকা। মোটের ওপর দেখা যায় মজুরি বৈষম্যের জন্য একজন নারী শ্রমিক বছরে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা কম আয় করেন। এর ফলে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি বড় বাধা।

সাত মাস আগের ঘটনা। মৌলভীবাজারে চা শ্রমিকদের দাবি ছিল মুজরি দৈনিক ৩০০ টাকা করার জন্য। ভাবতে হবে, দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে কি একজন মানুষের সংসার চলে? জেলা প্রশাসন নির্ধারণ করলো ১৪৫ টাকা। সেটাও মানলো না শ্রমিকেরা। যদিও পরে আন্দোলনটি সমঝোতার মাধ্যমে থেমে যায়।  

শ্রমিক বঞ্চনা নতুন নয় এ দেশে। শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীগণ এদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে। লোভী ও অমানবিক গোষ্ঠী যে মুনাফা ও সম্পদ তৈরি করে তা বহু বছরের শোষণ! সরকার ধনবানদের পক্ষে দাঁড়ায়। শোষিতরা অতি সাধারণ ও নিরীহ। তাদের কণ্ঠস্বর বাতাসে হারিয়ে যায়। এখানেও তাই হলো। থেমে গেলো নারী অধিকার!

করোনা অতিমারিতে দেশের পোশাক শিল্প মালিকদের রফতানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এ কথা বলে এ শিল্পের নারীনেত্রী সরকারের কাছে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিলেনও। কিন্তু শ্রমিকদের প্রণোদনা দূরে থাক; ঈদের আগে বেতন বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হলো পোশাক শ্রমিকদের। তৈরি পোশাক শিল্পে যেহেতু চা শ্রমিকদের মতো অধিকাংশ নারী, তারাও বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হলো। বিক্ষোভ হয়েছিল গাজীপুরে। করুণ এ দৃশ্য আমরা দেখেছি।  

দেশে নারীদের জন্য এখনও একটি সুস্থ ও সুন্দর কর্মপরিবেশ গড়ে ওঠেনি। নারীদের বৃহৎ অংশ দেশের প্রধান রফতানি বাণিজ্য তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশ অর্থনীতিতে নারীরা অবদান রাখছেন। অথচ নারী উদ্যোক্তারাও তাদের বঞ্চিত করেন। কর্মজীবী নারীদের একটি বিরাট অংশই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৭ শতাংশ নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় মৌখিক নির্যাতন বা গালাগালের শিকার হন। ৭১.৩ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের, ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের এবং ১২.৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

আমাদের দেশ কৃষিতে আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তার পেছনে অনেক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যার অন্যতম হলো কৃষি খাতে নারী শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮১ শতাংশ নারী গৃহসহ কৃষিকাজে সরাসরি অবদান রাখছেন। জমি প্রস্তুতকরণ, বীজ বপন করা, সার ও কীটনাশক দেওয়া, বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জাম তৈরি, ফসল মাড়াই করা, গবাদিপশু পালনসহ বিভিন্ন কাজে নারীদের অবদান অসামান্য। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষি খাতে নারীদের এই অবদানের কোনও সামাজিক স্বীকৃতি নেই। তাদের শ্রমশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না। এমনকি পারিশ্রমিকও দেওয়া হয় না। এভাবে কৃষি খাত ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন স্থানেই নারীরা বৈষম্যের শিকার হন।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কৃষিতে শ্রমদানকারী নারীদের ৪৫.৬ শতাংশ পারিশ্রমিক পান না। বাকি ৫৪.৪ শতাংশ বাজারমূল্যের থেকে কম পারিশ্রমিক পান। আর সর্বোপরি একজন নারীশ্রমিক পুরুষের থেকে ৪৩ শতাংশ কম মজুরি পেয়ে থাকেন। কর্মক্ষেত্রে নারীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি সময় কাজ করে থাকেন। যদিও এর জন্য তারা কোনও বাড়তি পারিশ্রমিক বা সুবিধা পান না। সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই এটা মেনে নেন। দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ নারীশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য হন।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, ২০২২ সালের (সাময়িক) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায় দেশে ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ কাজ করে। এরমধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৫ লাখ। শ্রম ও কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। এতে আগে ২ কোটি নারী ছিল, এখন তা বেড়ে ২ কোটি ৫৯ লাখ হয়েছে। আমাদের শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকদের একটি বড় অংশই হলো গ্রামীণ নারী, যারা স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। স্বল্প শিক্ষার কারণে একদিকে তারা যেমন কম মজুরির ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হন তেমনি তারা উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন। উন্নত শিক্ষার মাধ্যমে নারীরা নিজেদের দক্ষ করে তোলার সুযোগ পান না বলেই নির্মাণ শিল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাদের অংশগ্রহণ করতে হয়। আমাদের সমাজে নারী শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করা হয়। যা তাদের কর্মস্পৃহা ও উন্নত জীবনযাপনের পথে অন্তরায়। পারিবারিক চাপে বা প্রয়োজনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত হতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায় প্রাথমিক পর্যায় হয়তো অনেক নারীরা কাজ শুরু করেন। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হলে তারা পরিবারের চাপে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।

নারী উন্নয়নে নারীবান্ধব শেখ হাসিনার সরকার প্রথম লিঙ্গ বা জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে তা শুরু হয়। নারী উন্নয়ন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড রয়েছে এমন ৪টি মন্ত্রণালয়কে এ সময় যুক্ত করা হয়। পরে এর আওতা বৃদ্ধি করা হয়। ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সম্পৃক্ত করে জেন্ডার বাজেট ২০২৩-২৪ তৈরি করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ হলো ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪.৩৭ শতাংশ এবং জিডিপির ৫.২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ৮ম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) জেন্ডার সম্পৃক্ত রূপকল্প হলো দেশে নারী ও পুরুষের সমতাকরণ। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মস্থলে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন।

দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নারী হওয়ায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বত্র নারীর জয়জয়কার। দুই দশকে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ক্রীড়া এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সরকারি বেসরকারি ইতিবাচক মনোভাবের কারণে। অর্থনৈতিকভাবে নারী সমাজ অনেক অগ্রসর হয়েছে। অনলাইন ব্যবসায়, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জাগরণ হয়েছে ২ দশকে। এ কথা ঠিক, নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে কখনোই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে শুধু নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের শ্রমমূল্য বৈষম্য দূর করা তাই জরুরি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি হলেও মজুরি বৈষম্য যথাযথভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। মজুরি বৈষম্য নারী ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়। তাই প্রথমেই একটি মজুরি কাঠামো গঠন করতে হবে এবং নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকে মনে করেন সংসারে অভাব না থাকলে নারীদের বাইরে কাজ করার দরকার নেই। শ্রমজীবী নারীরা সারা দিন বাইরে কাজ করার পর ঘরে এসেও তাদের কাজ করতে হয়। এ সময়টাকে তাদের কর্মঘণ্টার মধ্যে হিসাব করা হয় না আর এর জন্য তারা কোনও মজুরিও পান না। নারীদের ঘরের কাজকেও শ্রম বলে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। গৃহকোণে নারীর শ্রমের অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণের কথা ভাবতে শুরু করেছে বর্তমান সরকার ।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ