X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

তবে কি সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত বড়?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৮ জুন ২০২৩, ২০:৩৭আপডেট : ২৮ জুন ২০২৩, ২০:৫৭

নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের বাজারে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী। তবে অসহায়ের মতো বলেছেন, বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হঠাৎ করে ক্রাইসিস তৈরি হবে। গত সোমবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় তিনি বলেন, ‘চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এটা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। আমাদের লক্ষ রাখা দরকার, আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ যে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে সেটা সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে’।

একটা দিক যে বাজারে কারসাজির একটা স্বীকারোক্তি এলো মন্ত্রীর মুখ থেকে। কিন্তু মন্ত্রী যখন বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট হবে, তখন নাগরিক হিসেবে আমরা এক দ্বিধায় পড়ে যাই। এতদিন জানতাম সরকারের হাত সবচাইতে লম্বা, এখন বুঝলাম সরকারের চাইতেও শক্তিশালী হলো বাজার সিন্ডিকেট, সরকার অসহায়। এটি যদি সত্য হয় তাহলে নাগরিক হিসেবে আমরা অনিরাপত্তায় পড়লাম। আর সত্য না হলে বাণিজ্যমন্ত্রীকে এর জবাব দিতে হবে কেন তিনি ভয় পান।

এ লেখা যখন লিখছি তখন সামান্য কাঁচা মরিচের দামও কেজিতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে, কমতি নেই কোনটা এবং কমাবার কোনও চেষ্টাও নেই সরকারের তরফ থেকে। মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে, কারণ টাকার দাম কেবল পড়ছে। কিছু দিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, আনাজ, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। মানুষ কষ্ট আছে এবং সেটা বুঝতে বড় অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবার-দাবারের পেছনে তাদের আয়ের বেশি অংশ ব্যয় করে থাকেন। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার মানে হলো তারা ভয়ংকর ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন।

খুচরো বাজারে জিনিসের দাম—বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে কেন? একটা বড় কারণ নিশ্চয় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। গত বছর মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানো হবে, কিন্তু হয়নি। সরকার কথা রাখেনি। সেই সর্বোচ্চ দামেই মানুষকে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে সব খাতে এবং অবশ্যই দ্রব্যমূল্যের বাজারে। দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, কাজেই সব জিনিসেরই দাম বাড়ার কথা।

কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে শুধু জ্বালানি তেলের দামই একমাত্র কারণ নয়। বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ ধরতে পারছে না। আমরা এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখেও শুনেছিলাম যে পণ্যের দাম ওঠানামার পেছনে একটা সিন্ডিকেট সবসময় কাজ করে। এরকম কথা শিল্প প্রতিমন্ত্রীও বলেছেন কিছু দিন আগে এবং তিনি এটাও বলেছিলেন যে মন্ত্রীদের মধ্যেই একটা সিন্ডিকেট কাজ করে। কিন্তু এবার টিপু মুনশির কথায় মনে হলো, সিন্ডিকেট ভাঙার চাইতে সিন্ডিকেটের কাছেই হার মেনেছে সরকার।

প্রশ্ন হলো, সেই সিন্ডিকেটের চেহারা বা চরিত্র কী? একটা বিষয় বোঝা যায় যে বাজারে একটা একচেটিয়াত্ব চলছে। কয়েকটি কোম্পানির হাতে পণ্য বাজার চলে গেছে এবং তাদের হাতে সবাই জিম্মি। এরাই বাজারে সক্রিয় আবার এরাই নীতিনির্ধারণী জায়গায় প্রভাব রাখে। অনেকটা এমন যে খেলোয়াড় আর রেফারি একই দলের। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছে, এরাই দাম ঠিক করছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও ব্যবসায়ী। ফলে গোল খাচ্ছে কেবলই জনগণ।

সাধারণত দেখা যায়, খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির একটা বড় কারণে ঘটে দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের জোগানে টান পড়লে। কিন্তু সেটা নেই। সরবরাহ ঠিকই আছে। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য শক্তির টানে দাম টান পড়ছে না। সেটাই কারসাজি। 

বাজারে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দামের উত্তাপ মানুষের গায়ে লাগছে, বিপাকে পড়েছে মানুষ। দীর্ঘকাল ধরে, কারসাজি করে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে মুনাফা করে যাচ্ছে এই সিন্ডিকেট। একদিকে সরকার খাদ্যপণ্যের বাজার দর ঠিক করে দিচ্ছে, অন্যদিকে একটি মহল জোটবদ্ধ হয়ে সেসব পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরা দুষ্কৃতকারী, ব্যবসায়ী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এর অধীনে নানা বিভাগ। আসল কথা হলো সরকারের সংস্থাগুলো সক্রিয় থাকলে মজুতকারীরা সাহস পেতো না। বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ একদমই কাজ করছে না।

ব্যবস্থা নিলে যে উপকার হয় তার প্রমাণ আছে। কিছু দিন আগে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল। বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় মনে হলো, ব্যবসায়ীদের কারসাজির কাছে সরকার পেরে ওঠে না। এই না পারাটা গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে বাণিজ্যমন্ত্রী দায়িত্ব আঁকড়ে আছেন কেন সেই প্রশ্ন উঠছে। সরকারের দিক থেকেও স্বচ্ছতার অভাব আছে। প্রায়ই মন্ত্রীরা সংকটের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের উদাহরণ টানেন, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলেন, যেন এই যুদ্ধের সব ভার কেবল বাংলাদেশই বহন করছে। অথচ তারা বলেন না– আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্য দাম বাড়েনি, সেসব পণ্যের দাম কেন বেশি আমাদের বাজারে? একটা স্বচ্ছতার অভাব সর্বত্র।  

বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন। বলেছেন সিন্ডিকেট সক্রিয়। কিন্তু কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযান হয় না সেটা না বলে ভিন্ন কথা বলে সিন্ডিকেটের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। একটা বিষয় মানুষ পরিষ্কার হতে চায়, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কী তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সম্পর্ক নিবিড় ও নিগূঢ়?

লেখক: সাংবাদিক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ