X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে ক্ষমতার সঙ্গে মমতার গুরুত্ব চাই

রেজানুর রহমান
২৯ জুন ২০২৩, ১১:৪৬আপডেট : ২৯ জুন ২০২৩, ১১:৪৬

তবুও ঈদ বলে কথা। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক অনেকেই পশু কোরবানি দেবেন। এই ঈদে নতুন পোশাক কেনার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। তাই বলে পোশাকের দোকানে ভিড় যে কমেছে তা নয়। যাদের অঢেল টাকা কড়ি আছে তারা দল বেঁধে মার্কেটে যাচ্ছেন। বিত্তহীন যারা, বেতনের টাকায় সংসার চলে এমন মধ্যবিত্ত মানুষ এবারের ঈদে অনেকটাই অসহায়। দেশের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সব সময় নানান চাপে থাকে। সংসার চালানোর চাপটাই বেশি। উচ্চবিত্তের একটা সুবিধা হলো, ইচ্ছে করলেই তারা হাত খুলে অন্যকে সাহায্য করতে পারে। বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হলো– উচ্চবিত্ত দেয়, নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা তা নিতে লজ্জা-সংকোচকে পাত্তা দেয় না। মাঝখানে মধ্যবিত্তের অসহায় অবস্থা। লজ্জা, সংকোচের কারণে তারা হাত পাতে না। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির করুণ দশা। এই ঈদে অনেকেই হয়তো কোরবানি দেবেন না। পোশাক কিনবেন না। অন্যের হাসি আর আনন্দ চেয়ে চেয়ে দেখবেন। সেই গানের কলির মতো– আমার বলার কিছু ছিল না। চেয়ে চেয়ে দেখলাম।

বাজার পরিস্থিতির ওপরই মূলত ঈদের আনন্দ আর খুশির পারদ ওঠানামা করে। বেশি দূরে যেতে চাই না। ২০২০ আর ২০২৩ এর একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরি। ২০২০ এ মোটা চাল ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। সেই চালের কেজি এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এক প্যাকেট আটার মূল্য ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা। সেই আটার প্যাকেট এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। যে সয়াবিন তেলের বোতল ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। সেই সয়াবিন তেলের বোতল তখন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা। যে চিনি ছিল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা কেজি, সেই চিনি এখন কিনতে হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। আলু ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। সেই আলুর কেজি এখন ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। গরুর মাংস ছিল ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি। সেই মাংস এখন ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা কেজি। ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। এখন ১৭৫ থেকে ১৯০ টাকা। ডিমের হালি ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। সেই ডিমের হালি এখন ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।

মাছ-মাংসের বাজারে গেলে সাধারণ ক্রেতার মাথা ঘোরে। ঈদের আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায় যখন পরিবারে ভালো খাবারের আয়োজন থাকে। সত্যি কথা বলতে কী বর্তমান সময়ে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে মাছ-মাংসের জোগান দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। এই সংকট ঈদেও প্রভাব ফেলবে। তাই নাড়ির টানে ঘরে ফেরার তাগাদাও অনুভব করছেন না অনেকে।

আমার পরিচিত একজন বেসরকারি চাকুরে বললেন, করোনা একবার ঝাপটা দিল। কোনও মতে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠলাম। কিন্তু রাশিয়া আর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে বাজারে নতুন করে যে ‘ধাক্কা’ শুরু হয়েছে তাতে বড্ড অসহায় বোধ করছি। আমার পরিবারে খাবার হিসেবে মাছ আর মাংসের জোগান কমে গেছে। এইতো কয়েক বছর আগেও ৫০০ টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত। এখন হাজার টাকার একটি নোটেরও যেন কোনও মূল্য নাই। আমার তো ভাই বেতন বাড়েনি। আগে যা ছিল তাই আছে। কিন্তু বাজারে জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ, তিন গুণ। সংসার সামলানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানে এবার ঈদ এসেছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে। মাফ করবেন, অনেক কষ্টে বাধ্য হয়ে কথাটা বললাম।

এটা হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির দীর্ঘশ্বাস। তবে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ঈদ আয়োজনে এতটুকু ভাটা পড়েনি। প্রতি ঈদে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কিছু মানুষ ঢাকায় আসে। সড়কের পাশে ফুটপাতে বসে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায়। ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করার বেলায়ও নাকি একটা সিন্ডিকেট আছে। ঢাকা শহরের নির্ধারিত কিছু এলাকার ফুটপাত অনেক দামী। কারণ এই সব এলাকার ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করলে অনেক টাকা পাওয়া যায়। যেমন, বায়তুল মোকাররম এলাকা, হাইকোর্টের মাজার এলাকা, নিউমার্কেট, বড় বড় বিপনী বিতানের সামনের ফুটপাত। ঈদে এইসব এলাকায় মন চাইল আর ফুটপাতে বসে ভিক্ষার জন্য হাত তুললাম, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তথাকথিত সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফুটপাত ভাড়া দেয়। ঈদের মৌসুমী ফকিরেরা এই বিষয়ে জানে। অহেতুক ঝামেলা না করে সিন্ডিকেটের কাছে ফুটপাত ভাড়া নিয়ে ভিক্ষার জন্য হাত তোলে। আয় রোজগার মন্দ হয় না। এদেরকে ভিক্ষা দেয় উচ্চবিত্ত শ্রেণি। উচ্চবিত্ত দেয়, নিম্নবিত্ত নেয়। মাঝখানে মধ্যবিত্তের ত্রাহি অবস্থা।

তার মানে এই নয় যে, ঈদে আনন্দ ফূর্তি হবে না। অবশ্যই আনন্দ ফূর্তি হবে। আর তাই নাড়ির টানে ঘরে ফিরছে মানুষ। পশুর হাটে ভিড় তো এতটুকু কমেনি। মার্কেটে ভিড় লেগেই আছে। প্রচার মাধ্যম বেশ সরব। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ৫ দিন, ৭ দিন ব্যাপি অনুষ্ঠান প্রচারের প্রতিযোগিতার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। সিনেমা হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন সিনেমা মুক্তি পাবে। ঈদের সিনেমার ভিড় লেগেছে। দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বেশ ভিড় দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ ঈদের ছুটি কাটাতে অনেকেই এখন পর্যটন নগরীতে সময় কাটাচ্ছেন। বিদেশেও গেছেন অনেকে। এত কিছু দেখার পরও কি বলা যায় এবারের ঈদটা কষ্টের হবে? মোটেই তা নয়।

দুই ঈদ আমাদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। যত সমস্যা সংকটই থাকুক না কেন ধনী-গরিব সবারই চেষ্টা থাকে অনবিল আনন্দের মাঝে ঈদকে রাঙিয়ে তোলার। দ্রব্যমূল্যের সংকটের মধ্যেও ঈদ রঙিন হবে। ঈদের দিন যার যার সাধ্যমত খাবার-দাবারের আয়োজন থাকবে। ঈদ উৎসব বলে কথা।

কিন্তু ঈদ উৎসব কি আগের মতো আছে? ঈদ উৎসব ধনী-গরিবের বৈষম্য মানে না। পাশের বাড়ির অভাবগ্রস্ত মানুষের খোঁজ না নিয়ে যদি কেউ বিপুল অংকের টাকায় গরু কিনে কোরবানি করে ধর্মীয় মতে এই কোরবানির কোনও অর্থ হবে না। শুধু কোরবানির কথাই বা বলছি কেন? ঈদের নামাজ শেষে আশে পাশে বসা মুসল্লির সঙ্গে কোলাকুলি করার ধর্মীয় বিধান কি আমরা ইদানিং মানি? গত ঈদে নিকেতন কেন্দ্রীয় মসজিদে আমি ঈদের নামাজ পড়েছি। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার জন্য ডানে এবং বামে বসা দুই মুসল্লিকে পেলাম না তারা নিমিষে হাওয়া। সামনে পিছনে, ডানে বায়ে অসংখ্য মানুষ। মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাবার স্রোতে শামিল সবাই। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকি। একজনের সঙ্গেও কোলাকুলি করার সুযোগ হলো না। এ কেমন ঈদ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম না।

গ্রামেও কি এমন অবস্থা? বহু বছর গ্রামে ঈদ করার সুযোগ হয়নি। কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল রাজারহাট ইউনিয়নের বালাকান্দির কৈকুরি গ্রামে আমার বাল্যকালের অনেকটা সময় কেটেছে। ছোট্ট ঈদগাহ এ ঈদের নামাজের স্মৃতি এখনও বেশ জ্বলজ্বলে। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করতেই অনেক সময় লেগে যেত। তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। আহা! কত আনন্দেরই না ছিল সেই সব দিনগুলো।

তার মানে এখন কি ঈদের আনন্দ নেই। এখন তো বিস্তর আনন্দ। টিভি চ্যানেল সমূহের টানা ৫ দিন, ৭ দিনের অনুষ্ঠান। পাশাপাশি আছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যাপক ঈদ আয়োজন। হাতে যদি থাকে একটি মোবাইল ফোন তাহলে ঈদ আনন্দ এসে যাবে হাতের মুঠোয়। তবুও অতীতকালের ঈদ উৎসব আর বর্তমান সময়ের ঈদ উৎসবের মধ্যে অনেকটাই ফারাক। তবে এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। তর্কে যেতে চাই না। লেখাটি শেষ করি কয়েকটি প্রত্যাশার কথা বলে।

ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। আপনার প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনদেরও এই উৎসবে শরিক করুন। আপনি আনন্দ করছেন অথচ পাশের বাড়ির পরিবারটি অনেক কষ্টে আছে। তার বা তাদের পাশে দাঁড়ান। তার বা তাদের হাসিমাখা মুখগুলোই হতে পারে এই ঈদে আপনার সেরা আনন্দ।

অনেকে অন্যকে দেখানোর জন্য একাধিক পশু কোরবানি দেন। কোরবানির পশুর মাংসের একটি নির্ধারিত অংশ বাদে অন্য অংশ দুস্থ মানুষ ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। এই নিয়মটা মানার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকুন।

ঈদ মানেই আনন্দ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ঈদ অনুষ্ঠান এক্ষেত্রে অনেক প্রভাব ফেলে। দেশে এই মুহূর্তে ৩০টিরও বেশি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। প্রতিটি টিভি চ্যানেল নাটক, সিনেমার পাশাপাশি ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। কাজেই ভিন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান না দেখে এবার দেশের প্রতি গুরুত্ব দিন। ঈদে একাধিক নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সময় করে সিনেমা হলে যেতে পারেন। একটি নতুন খবর হয়তো অনেকেই জানেন না। সিনেমার মতো ঈদের দিনও ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে নতুন নাটক মঞ্চস্থ হবে। ঘুরে আসুন শিল্পকলা একাডেমি থেকে। সবার জন্য শুভ হোক এবারের ঈদ উৎসব।

ঈদ আনন্দে ক্ষমতার সঙ্গে মমতা অর্থাৎ মায়া, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস গুরুত্ব পাক। ঈদ মোবারক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।       

/এফএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
এই গরমে তরমুজ খাবেন যে ৭ কারণে
এই গরমে তরমুজ খাবেন যে ৭ কারণে
বার্সেলোনার ‘প্রতিশোধ’ মাদ্রিদ ওপেনে নিলেন নাদাল
বার্সেলোনার ‘প্রতিশোধ’ মাদ্রিদ ওপেনে নিলেন নাদাল
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ