X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বার্থই যার প্রধান নীতি

আবদুল মান্নান
০১ জুলাই ২০২৩, ১৮:৩৮আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৩, ১৮:৩৮

অনেকেই মনে করে বিশ্বে এই মুহূর্তে একমাত্র নীতিবাদী দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি যে কতবড় বিভ্রান্তিকর তথ্য— সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর তা আবারও পরিষ্কার করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কোনও অবস্থাতেই নিজের স্বার্থের বাইরে এক কদমও ফেলবে না— মোদির এই সফর তা আবারও প্রমাণিত। নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

ইতিহাস প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র স্বার্থ তার করপোরেট বা অর্থনৈতিক স্বার্থ। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এই সব কিছুই হচ্ছে কথার কথা। মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, তখন সেখানে সংগঠিত হয় এক ভয়াবহ দাঙ্গা। প্রাণ হারায় হাজারের ওপর মানুষ। ভারতে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র এই অজুহাতে মোদিকে কালো তালিকাভুক্ত করে তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো। এর কিছুদিন পরেই ভারতে অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সেই নির্বাচনে জয়ী হলে সবার আগে গুজরাটে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হলো ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। মোদি তখনও সরকার গঠন করেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে মোদিকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানাতে ভুললেন না পাওয়েল।

হাজার হলেও ভারত জনসংখ্যার দিক হতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। একটি উঠতি অর্থনীতি। ২০৫০ সাল নাগাদ হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক তেমন একটা ভালো নয়। এবার মোদির আগে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ জন আইন প্রণেতা নিজ দেশের প্রেসিডেন্ট বরাবর পত্র মারফত জানালেন— তিনি যেন মোদির সফরের সময় ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টা আলাপ করেন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র সাফ জানিয়ে দিলেন, মোদিকে মানবাধিকার বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া তাদের কাজ নয়।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীতা তো ঐতিহাসিক। ৫০ বছর আগে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি লিখে হুমকি দিতো। এখন তা দিতে হয় না। এই যুগে কেউ কাউকে অস্ত্র দিয়ে হুমকি দেয় না। শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ জেতা যে সম্ভব নয়, তা ইউক্রেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর আফগানিস্তানে সব ধরনের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এক কাপড়ে পালাতে হয়েছে। প্রতিপক্ষ জোব্বা আর পাগড়ি পরা কয়েক হাজার তালেবান। আবার এই তালেবানদের সত্তরের দশকে সৃষ্টি করেছিল আমেরিকা, আফগানিস্তান দখলকারী তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীকে মোকাবিলা করতে। আফগানিস্তানের খনিজসম্পদের ওপর বিশ্বের সব পরাশক্তির নজর রয়েছে। সোভিয়েতরা অবস্থা বুঝে মানে মানে আগে সটকে পড়েছিল। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তি সব চেয়ে বড় শক্তি। চীন অস্ত্রের জোরে নয়, তার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জোরে বিশ্বের এখন অন্যতম পরাশক্তি। আফ্রিকা বা এশিয়ায় বর্তমানে চীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলেছে। দেশটির ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে তাদের অনেক পুরনো পরীক্ষিত মিত্র বর্তমানে চীনকে তাদের পরম মিত্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। সৌদি আরবসহ প্রায় সব আরব দেশই এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পরম মিত্র মনে করে না, যতটা করে চীনকে। আফ্রিকা অনেক আগে হাতছাড়া। বাংলাদেশে কিছু রাজনৈতিক দল, আর এক শ্রেণির সব জান্তা সুশিল ব্যক্তি সর্বদা নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন নিয়ে বেশ অশান্তিতে থাকেন। তারা হয়তো জানেন না চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কত ধরনের নিষেধাজ্ঞা, অথচ চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক পণ্য আমদানি করে। বছরে আনুমানিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ওপর। আর চীনে রফতানি মাত্র দেড়শ বিলিয়ন ডলার।

করপোরেট স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের কত দেশ ধ্বংস করেছে তা এখন কোনও গবেষণার বিষয় নয়। ইরানে ১৯৫৩ সালে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছিল তাদের এই কর্মযজ্ঞ। স্বার্থ সেই দেশের বিলিয়ন ডলারের তেলসম্পদ। এই লুটপাটের মচ্ছব চলেছে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। তারপর আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি বিপ্লব শাহকে উৎখাত করে নির্বাসনে পাঠায়। শাহকে বাঁচানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে। শাহ’র শেষদিনগুলো কাটে যুক্তরাষ্ট্রে। মৃত্যুর পর তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, তা কেউ তেমন একটা জানে না। কারও কারও মতে হয়তো মিশরে। সেই ইরান এখন একটি পারমাণবিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমীহ করে। এমন উদাহরণ অজস্র আছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে ভারতে না যত বেশি আলোচনা, তার চেয়ে সম্ভবত বাংলাদেশে বেশি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চারদিকে বেশ সোরগোল। বিএনপি তার ডান- বাম মিত্ররা দাবি তুলছে— এই নির্বাচন শেখ হাসিনাকে সরকারে রেখে অনুষ্ঠিত হলে তাদের বিজয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বেশ কিছু বামপন্থী দল। সঙ্গে নিয়েছিল সব ধরনের মৌলবাদী সংগঠনকে। যে কোনোভাবেই হোক জাতির পিতাকে উৎখাত করতে হবে। সঙ্গে তো দলের ভেতরের কিছু লোকও ছিল। তাতে সুবিধা অনেক। সব ষড়যন্ত্রকারীদের একটাই লক্ষ্য— বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে যে কেউ ক্ষমতায় থাকলে  তাদের আপত্তি নেই। তাঁর কন্যার বেলায়ও এই মুহূর্তে একই কথা প্রযোজ্য। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা ছাড়া যেকোনও দুর্বৃত্ত, পলাতক আসামি, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থপাচারকারী বা অস্ত্র ব্যবসায়ী, চোরাচালানি, ব্যাংক লুণ্ঠনকারী তষ্কর, জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী, সাজাপ্রাপ্ত আসামি যে কেউ ক্ষমতায় আসুক কোনও আপত্তি নেই। শেখ হাসিনাকে রুখতে হবে। তাদের বড় মুখপাত্র এই দেশের কিছু মিডিয়া আর এক শ্রেণির পোষা সাংবাদিক। আছেন কিছু সুশীল নামধারী সুবিধাভোগী ব্যক্তি আর গোষ্ঠী। তাদের আসল রোগটা হিংসা। শেখ হাসিনা কেমন করে দেশটার অন্য পরিচয় এনে দিলো যে সারা বিশ্বে তিনি একজন স্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক? যখন শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুটা দেশের অর্থে করে দিলেন তখন তারা চুপ। অথচ এই মানুষগুলোই শুরুতে নিত্যদিন টিভিতে বলেছিলেন, পত্রিকায় লিখেছিলেন– ‘নিজের টাকায় পদ্মা সেতু কোনও পাগলও বিশ্বাস করবে না’। সেই সেতু তার প্রথম জন্মদিন পালন করলো ক’দিন আগে।

 

আসি আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হৈচৈ আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রসঙ্গে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরটা একটি রাষ্ট্রিয় সফর। দুই দেশের মধ্যে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, গবেষণা, তথ্য প্রযুক্তি, সেবা খাত-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত ভারতীয়দের দখলে। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপর, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ভারত বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অবস্থান সব সময় সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।  ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মূলধনি যন্ত্রপাতি আর শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের একটি বিরাট বাজার। পরস্পর-পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টাকে দু’দেশ সব সময় প্রাধান্য দেবে, তাতে অবাক হবার কোনও কারণ নেই। মোদিকে যখন ভিসা স্যাংশন দিয়েছিল, তখন তিনি ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। জাতীয় নির্বাচনের পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সব ধরনের সম্পর্কের বোঝাপড়া তো তার সঙ্গে করতে হবে। দিন শেষে তো করপোরেট বা অর্থনৈতিক স্বার্থ। সেই নরেন্দ্র মোদি এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে এমন সমাদ্রিত যে বাইডেন সাহেবের স্ত্রী তার রসুই ঘর পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন মোদির জন্য, নিরামিষ রান্নার আয়োজন করার জন্য।

এই দেশের মানুষের দৃষ্টি মোদি বাংলাদেশের ব্যাপারে বাইডেনকে কী বলেন সেই দিকে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন অন্য দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে যান, তখন তিনি তার নিজ দেশের বিষয়াদি নিয়ে কথা না বলে কেন অন্য দেশের কথা কেন বলবেন? বলবেন তখনই যখন ওই দেশের কোনও কর্মকাণ্ডে নিজ দেশের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তখন। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও দেশ যখন পাকিস্তানকে আধুনিক সমারাস্ত্র সরবরাহ করে, তখন ভারত স্বাভাবিক কারণে তার প্রতিবাদ করে। কারণ, ভারত মনে করে, এতে জাতীয় নিরাপত্তা খর্ব হচ্ছে। একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত মিত্র বাংলাদেশের বেলায় কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, যা ভারতের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা হলে তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করতেই পারেন। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা সেই দেশের গুটি কয় রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্যে মনে হতে পারে— আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র বোধ হয় শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসা উচিত নয়। তবে দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কেউ কী চায় তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সব সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। শেষ দিন পর্যন্ত দেশটি বাংলাদেশের পিঠে ছুরি মারতে চেয়েছিল। দেশের মানুষ চেয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সব ষড়যন্ত্র বা বাধা উড়ে গেছে।

স্বাধীনতার পরও যুক্তরাষ্ট্র মনে-প্রাণে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে যে সপরিবারে হত্যা করা হলো, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সহায়তা ছিল তা এখন পরিষ্কার। সেই দেশের গবেষকরাই তা বলেছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী চাইবেন তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে এমন একটা সরকার থাকুক, যা তার জাতীয় নিরাপত্তা বা অন্যান্য স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয়। ভারতের নিকট প্রতিবেশী মানে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ। মালদ্বীপ একটু দূরে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনও সুখের ছিল না। নেপাল আর ভূটানের যেহেতু চীনের সঙ্গে সীমান্ত আছে, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রাখতে হয়। শ্রীলঙ্কা তার নিজের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করে। ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক স্বার্থে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ প্রয়োজন অনেক বেশি। স্বাধীনতার পর ভারত বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকার দেখেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনকালটা ছিল বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া, যা তিনি করেছিলেন। তিনি এটিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের অসাধারণ ভূমিকার কারণে। সেই দেশের সাধারণ জনগণ আর সরকার সেই সময় যে ভূমিকা রেখেছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দুই দেশের সম্পর্কেও এক কালো অধ্যায় শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ৩০ লাখ  প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে আর একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরের নীল নকশা বাস্তবায়নে হাত দিয়েছিলেন। সেই সময় তার সরকারের জ্ঞাতসারেই পাকিস্তানের আইএসআই  এই দেশে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছিল। উদ্দেশ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সব ধরনের মদদ দেওয়া। জিয়া সেই উদ্দেশ্যে অনেকটা সফল হয়েছিলেন। জিয়া হতে খালেদা জিয়ার আমল পর্যন্ত আইএসআইয়ের মদদে কীভাবে ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তা সম্প্রতি ভারতের একাধিক শীর্ষ স্থানীয় গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তারা ভারতের মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। তখন ভারতের এই অঞ্চলে শান্তি বজার রাখার জন্য বছরে কোটি কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় করতে হতো, যা এখন আর করতে হয় না। খালেদা জিয়ার আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ সংসদে দাঁড়িয়ে জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন— এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দল আসলে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তাদের নৈতিক সমর্থন দেওয়া বাংলাদেশের কর্তব্য। খালেদা জিয়ার দই দফা শাসনামলে তো এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিদেশ থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহার করতো।

২০০৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক তার একটা বড় উদাহরণ, আর তার নিয়ন্ত্রক ছিল লন্ডনে পলাতক খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, যা এরইমধ্যেই আদালতে প্রমাণিত।

জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতির তেমন কোনও হেরফের হয়নি। অপরদিকে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি এ সব শুধু বন্ধই করেননি, একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে আটক করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছেন। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ বদলে দিয়েছে সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াটা ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি মাইল ফলক।

আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে থাকে, তখনই দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। দুই দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের যাতায়াত বাড়ে। সরকারি হিসাব মতে, বছরে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি ভারতে নানা কাজে বা ছুটি কাটাতে  যাতায়াত করে। ভারতে বিদেশি ভ্রমণকারীদের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়। সেই দেশে তারা কম করে হলেও সোয়াশ’ মিলিয়ন ডলার খরচ করে যা ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। অপরদিকে আনুমানিক দেড় লাখ ভারতীয় প্রতি বছর ব্যবসা বাণিজ্যসহ অন্য কাজে বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন, আর বছরে ন্যূনতম পাঁচ বিলিয়ন ডলার সেই দেশে পাঠায়। যেমনটা বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মানুষের কর্মকাণ্ডে এই দেশে কেউ কেউ মনে করেন, শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এক মুহূর্তও আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কথাটা হয়তো সত্য কারণ,  শেখ হাসিনাকে তারা তাদের তাবেদার বানাতে পারেনি, যেমন- পারেনি তার পিতাকে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা যে সব সময় তাদের তাবেদার হতে প্রস্তুত, তা তাদের অতীত অনেক কার্যকলাপ হতে প্রমাণিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। তিনি এখন দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে সাজা খাটছেন। তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান অনেকগুলো মামলায় দীর্ঘ মেয়াদি সাজা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জেমস মোরিয়ার্টি। তিনি তার দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্টে লিখেছিলেন, ‘তারেক রহমান একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্য তিনি খুব ক্ষতিকারক। তাকে যেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য কখনও কোনও ভিসা দেওয়া না হয়’। প্রকাশ্যে ঘোষণা করে কোনও বাংলাদেশিকে ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। সেই তারেক রহমানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি।

সব শেষে বলি, ইতিহাস বলছে— যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের করপোরেট স্বার্থে অন্য দেশের বারোটা বাজাতে চায় তারা শুরু করে মানবাধিকার দিয়ে। তারপর আসে গণতন্ত্র, আর গণতন্ত্র মেরামত করতে তাদের হয়ে তখন ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে তৃতীয় শক্তি। প্রয়োজন পড়লে এরপর রফতানি করে অশান্তি। ভাড়ায় খাটার জন্য শক্তি এখন বাংলাদেশে সহজ লভ্য। অতএব সাধু সাবধান।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ