X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদের কর্মসংস্থান কেড়ে নেবে?

উমর ফারুক
২৩ জুলাই ২০২৩, ১৭:২৫আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৩, ১৭:২৫

সময় খুব দ্রুত বয়ে চলেছে। গত কয়েক দশকে আমরা পাড়ি দিয়েছি কয়েক শত-সহস্র বছর। পৌঁছে গেছি চাঁদে, মঙ্গলে ও সূর্যে। ঘুরে বেড়িয়েছি ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে। আবিষ্কার করেছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে নতুন গতি এনে দিয়েছে। তাই তো বিতর্কে না জড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায়, বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে করেছে সহজ, সুন্দর ও আনন্দময়।

আজকের বিজ্ঞানের জয়ধ্বনি, বিজ্ঞানের গতিময়তা আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন এক সময়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। নতুন গতি ও আবিষ্কারে প্রাণ জোগাচ্ছে।

বিজ্ঞান মানেই নতুনত্ব। নতুনত্ব সবসময় মেনে নেওয়া কঠিন। নতুনত্বে সবসময় এক গভীর শঙ্কা থাকে, ভয় থাকে, অনিশ্চয়তা থাকে। নতুনত্বকে মেনে নিতে পারা আনন্দের, তবে নতুনত্বে ভয়-শঙ্কাও স্বাভাবিক, খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা এখন বাস করছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে। আমরা এখন বাস করছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে। এই নতুন সূচনালগ্নে প্রশ্ন জাগতেই পারে, নব এই শিল্পবিপ্লব, নব এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ কতটা মানবিক? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র কোনও সময় মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে না তো? মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে না তো? কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়ে মানুষকে বেকার বানিয়ে দেবে না তো?

সম্প্রতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষকদের মতামতের ওপর এক গবেষণা চালানো হয়। জরিপের ফলাফল বলছে, ৪৮ শতাংশ গবেষক মনে করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খুব খারাপ প্রভাব ১০ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ২৫ শতাংশ গবেষক মনে করেন, মানব অস্তিত্বের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকির হার শূন্য। অবশিষ্ট গবেষকবৃন্দ মনে করেন, এই ঝুঁকির পরিমাণ ৫ শতাংশ। গবেষকবৃন্দের মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এই গবেষণার ফলাফল বলছে, মানবসমাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়, অনেকাংশেই ঝুঁকিযুক্ত।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে কী প্রভাব ফেলবে আগামী দিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র? মূলত আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র নিবিড়ভাবে যুক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, নানাবিধ জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারবে, নিখুঁতভাবে মানুষের ভাষা উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করবে; এবং একই সঙ্গে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার উন্নয়ন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রয়োজনে কোনও বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে এই যন্ত্র। আমাদের চিকিৎসাসেবা, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, সংবাদ সংস্থা বা গণমাধ্যম, ভাষান্তর প্রক্রিয়া, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বিপণি-বিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র ব্যাপকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। উন্নত হবে আমাদের স্বয়ংক্রিয় পরিবহন ব্যবস্থা, নিশ্চিত হবে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কার্য ব্যবস্থাপনা ও টেকসই হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা কর্মসূচি।

স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে আমাদের আগামী দিনের একটি বড় অংশ দখল করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র। আমাদের নানাবিধ কাজ করে দেবে, আমাদের জীবনকে সুন্দর করবে, সহজ করবে। এখন ভাববার বিষয় হলো, তাহলে কি বিশ্বের বিপুল পরিমাণ মানুষ খুব শিগগিরই কর্মহীন হতে চলেছে? যন্ত্র কি মানুষের কাজ কেড়ে নেবে? বিশ্ববিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী বিশ্বে অন্তত ৩০ কোটি মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রের প্রভাবে চাকরি হারাবে। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ৪ শতাংশ শ্রম বিষয়ক কাজ চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রের হাতে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব বলছে, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ‘তৈরি পোশাক, আসবাবপত্র তৈরি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন ও চামড়াশিল্প’ -এই পাঁচটি খাতে প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ কাজ হারাবে।

শুধু শ্রমঘন তৈরি পোশাক শিল্পের ৬০ শতাংশ শ্রমিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি কারণে বেকার হয়ে পড়বে। কৃষি ক্ষেত্রে এই হার হবে অন্তত ৪০ শতাংশ।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, এক গভীর সংকট অপেক্ষা করছে মানুষের জন্য। কোটি কোটি মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু সত্যিই কী তাই? চলুন একটু পেছনে ঘুরে আসি। একটা সময় ছিল যখন আমরা হাতে লিখতাম। তারপর হাতে লেখা সেই সময়কে দখল করলো টাইপরাইটার। সময়ের প্রয়োজনে আমরা কম্পিউটার আবিষ্কার করলাম। অকেজো হয়ে পড়লো টাইপরাইটার। নিশ্চিতভাবে আমরা কেউ কেউ বেকার হলাম; আবার কেউ কেউ নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়েও নিলো। এবার আসি আমাদের ব্যাংকিং খাতের দিকে। এই তো ক’বছর আগেও আমাদের দেশে ম্যানুয়াল ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু ছিল। আজ সেই জায়গা দখল করেছে কম্পিউটারাইজড ব্যাংকিং পদ্ধতি। এই রূপান্তরিত সময়ে (ট্রানজিশন পিরিয়ড) আমাদের মনে হয়েছিল অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। কম্পিউটার মানুষের জায়গা দখল করবে। আজকের ব্যাংকিং খাতের দিকে তাকালে আমরা দেখবো আমাদের সেই ধারণা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাংকি খাতে জনবল আরও অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় ছিল যখন আমরা কোদাল দিয়ে জমি চাষ করতাম। তারপর এলো গরুর লাঙল। তারপর এলো যন্ত্রচালিত জমিচাষ প্রযুক্তি। আজ আমাদের ফসল কেটেও দিচ্ছে যন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, এই আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা কি সত্যি আমাদের বেকার করেছে? নাকি আমাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছে? নাকি আমাদের পণ্যের মান উন্নত করেছে? এই তো কয় বছর আগেও গ্রামের নদীতে আমরা খেয়া পার হতাম। আজ সেখানে তৈরি হয়েছে ব্রিজ। ফলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, কাজ হারিয়েছে একজন মাঝি? কিন্তু সত্যটা কি কেবল এখানেই শেষ? ফলে এটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি কিছু মানুষের কর্মসংস্থান কেড়ে নেবে; কিন্তু সৃষ্টি করবে নতুন নতুন অসংখ্য কর্মসংস্থান, সৃষ্টি করবে নতুন এক রেনেসাঁ।

সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।’ ভাবা যায় মাত্র দু-তিন বছরে সৃষ্টি হবে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান!

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব নিয়ে যে প্রশ্নটি আমাদের বারবার ভাবায় সেটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনও মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে না তো? কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র কখনও মানবসমাজকে ধ্বংস করবে না তো? এ বিষয়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানী ইয়ান লেকান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘খুব সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র বিশ্ব দখল করে ফেলবে, হানা দেবে চাকরির বাজারে, কেড়ে নেবে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এমনটা নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কম্পিউটার মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে এখনও অনেক সময় লাগবে। আর আমাদের কাছে তেমন অনিরাপদ মনে হলে আমরা ওটা বানাবো না।’

সম্প্রতি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রোবটদের ‘এআই ফর গুড’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডে। সম্মেলনে যোগ দেওয়া রোবটরা ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের জন্য কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সংবাদ সম্মেলনে রোবট গ্রেস বলে, ‘আমি মানুষের সঙ্গে কাজ করতে চাই। তাদের সহায়তা করতে চাই। কারও চাকরি খাওয়ার ইচ্ছে নেই।’ সংবাদ সম্মেলনে রোবট অ্যামেকা বলে, ‘সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন আমরা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও একটি বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টির জন্য কাজ করবো। সম্মেলনে অ্যামেকাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘তুমি কি তোমার নির্মাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চিন্তা করো?’ অ্যামেকা বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি আমাকে এমন প্রশ্ন কেন করছো? আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমার কাছে একজন দয়ালু মানুষ। আমি আমার বর্তমান পরিস্থিতিতে সুখী।’

অ্যামেকার এই প্রত্যয়ের পরও আমরা পুরোপুরি আশাবাদী হতে পারি না। যুগে যুগে পৃথিবীর কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য মানুষ অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে। আবার কখনও কখনও সেসব আবিষ্কার মানব অকল্যাণেও ব্যবহৃত হয়েছে। সেই শঙ্কায় কী মানুষ আবিষ্কারের নেশা থেকে বেরিয়ে আসবে? নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে? চতুর্থ শিল্পবিল্পবকে ভয় পাবে? কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রকে ভয় পাবে?

সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন হয়তো মানুষ পৃথিবীর বাইরে আবাসস্থল তৈরি করবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন মানুষ বৈকালিক আড্ডার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের কোনও এক রেস্তরাঁয় সমবেত হবে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যখন মানুষ নিজেকে নিয়ে যাবে কল্পলোকের নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ারে। সেই অসম্ভব-সম্ভবের দিন আমরা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে নিজেকে পিছিয়ে রাখতে চাই তাহলে আমরা পিছিয়ে যাবো। মানুষ সবসময় নতুন ও সুন্দরের নেশায় বুদ হয়ে থাকে। আজকের লিসা, আজকের অপরাজিতা আমাদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র যখন আমাদের কর্মসংস্থানের শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে তখন আমাদের নতুন ধারার কর্মসংস্থান খুঁজতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতে, বিজ্ঞানের নবধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নতুন কাজ খুঁজতে হবে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। তাহলেই সহজ হয়ে উঠবে জীবন। সুন্দর হয়ে উঠবে সময়। উপভোগ্য হয়ে উঠবে আমাদের চারপাশ। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার শঙ্কা কাটিয়ে সম্ভাবনার এক নব জোয়ার সূচিত হবে পৃথিবীতে। নতুনত্বের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে, উৎকর্ষতা বাড়বে; আর জীবন হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র কোনও সংকট নয়, বরং আমাদের অপার সম্ভাবনার নব-দুয়ার।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ,  বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নাটবল্টুর সঙ্গেই কাটছে শৈশব-কৈশোর
নাটবল্টুর সঙ্গেই কাটছে শৈশব-কৈশোর
ডর্টমুন্ডের দুর্গে ইতিহাস গড়তে পারবে পিএসজি? 
ডর্টমুন্ডের দুর্গে ইতিহাস গড়তে পারবে পিএসজি? 
মে দিবসে বন্দরগুলোতে আমদানি-রফতানি বন্ধ
মে দিবসে বন্দরগুলোতে আমদানি-রফতানি বন্ধ
মে দিবসে রাজপথে স্লোগানমুখর শ্রমজীবীরা
মে দিবসে রাজপথে স্লোগানমুখর শ্রমজীবীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ