X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

উপাচার্যের ভিসার আবেদন ও আমাদের সাংবাদিকতা

আনিসুর রহমান
৩১ জুলাই ২০২৩, ১৯:৪৬আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৩, ১৯:৪৬

দিন কয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কানাডার ভিসা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যম খবর প্রচার করেছে। খবরের সারকথা হলো উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান কানাডার ভিসা না পেয়ে কমনওয়েলথভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংস্থা আয়োজিত দেশটির ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে যেতে পারলেন না। 

আয়োজকদের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, আমন্ত্রিত অতিথিদের সশরীরে উপস্থিত হয়েই আয়োজিত কর্মসূচিগুলোতে অংশ নিতে হবে। ১৮ জুলাই অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে শেষ পর্যন্ত উপাচার্য অনলাইনে যুক্ত হয়ে অংশ নিয়েছেন। ভিসার দীর্ঘসূত্রতার জন্যে আয়োজকদের তরফ থেকে উপাচার্য বরাবর  দুঃখও প্রকাশ করা হয়েছে।

উপাচার্য ভিসার জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন ১৫ জুন। তার পাসপোর্ট এখনও ঢাকাস্থ কানাডীয় হাইকমিশনে। দূতাবাস থেকে উপাচার্যকে ভিসা দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে এখনও কিছু জানানো হয়নি। অথচ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রচার করা হলো– তাকে ভিসা দেওয়া হয়নি। খবরের কোথাও দূতাবাসের বক্তব্য নেওয়া হয়নি।

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঢাকা থেকে কানাডার ভিসা পেতে প্রায় দুই মাস লাগে। এটাই নিয়ম। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবেদন করেছেন এক মাস আগে। তাই ওনাকে ‘ভিসা দেওয়া হয়নি’ এরকম প্রচারণা সংগত নয়। আমাদের সাংবাদিকতার গলদটাও এখানেই।

গলদমুক্ত সাংবাদিকতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের উচিত ছিল ঢাকাস্থ কানাডীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য নেওয়া। প্রতিবেদক এই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়ে থাকলে, যিনি এরকম একটি প্রতিবেদন সম্পাদনা করেছেন তার সংগত পেশাদারি দায়িত্বশীল আচরণ হতো প্রতিবেদককে দিকনির্দেশনা দেওয়া। দূতাবাসের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা ছাড়া এই প্রতিবেদন আটকে রাখা।

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে থাকা দেশের নাগরিকদের সঙ্গে ভিসা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা বা দীর্ঘ প্রক্রিয়া নতুন কিছু নয়। সেই ক্ষেত্রে ‘জরুরি বিবেচনা’ বলে একটি কথা থাকে সবসময়। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় কানাডার কাঙ্ক্ষিত ভিসা পেতে দুই মাস লাগার কথা বটে। তবে এখানে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময়সূচির দিকে নজর দিয়ে এক মাস সময়ের ভেতরে ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা করলে বরং সংগত আচরণ করতেন।

এই ক্ষেত্রে উপাচার্যের ভিসার আবেদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রয়োজনে কূটনৈতিক রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী যোগাযোগ করতে পারতেন। প্রয়োজনে বিষয়টি সরাসরি হাইকমিশনারের নজরে আনতে পারতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন উপাচার্যের ভিসা পেতে এতটা সময় লাগবে কেন। 

উপাচার্যের ভিসার জটিলতার কারণে কানাডা যেতে না পারার কারণে যদি বিব্রত হতে হয় তাহলে বিব্রত হতে হবে ঢাকার কানাডীয় হাইকমিশনকে এবং আয়োজক কর্তৃপক্ষকে। কেননা, আমন্ত্রণ তো তাদের তরফ থেকেই এসেছে। এমন তো নয় উপাচার্য বেড়াতে যাওয়ার জন্যে ভিসার আবেদন করেছেন। আয়োজকরা ইতোমধ্যে উপাচার্য বরাবর আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন ঢাকাস্থ হাইকমিশনের জন্যও সংগত হবে উপাচার্যের পাসপোর্ট যখন ফেরত দেবে এবং বিলম্বিত ভিসা যখন দেবে, আশা করি সেই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

এবার ভিসা জটিলতা নিয়ে কয়েকটি গল্প বলতে চাই।  একবার ইউরোপের একটি দেশে আন্তর্জাতিক এক লেখক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্যে দেড় দশক আগে ঢাকাস্থ একটি দূতাবাসে আবেদন জমা দিয়েছিলাম প্রায় শেষ সময়ের মধ্যে। সম্মেলনের তারিখ প্রায় কানের কাছে এসে গেছে, কিন্তু ভিসা পাচ্ছি না। ঘটনাক্রমে ওই দূতাবাস আয়োজিত ঢাকাস্থ ওয়েস্টিন হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে খোদ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। ওনার সঙ্গে সৌজন্য কথাবার্তার মধ্যেই ভিসার জন্যে আমার আবেদনের বিষয়টি নজরে এনেছিলাম। তিনি  জানালেন পরের দিন অফিসে গিয়েই বিষয়টির খোঁজ নেবেন। তিনি আমাকে একটি মেইল পাঠিয়ে রাখতে বললেন। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন দূতাবাস থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো আপনার ভিসা হয়ে গেছে, এসে পাসপোর্ট নিয়ে যান। 

একবার আমাদের দেশের প্রথম সারির একজন কবি প্রতিবেশী একটি দেশের রাজধানীতে সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। যথারীতি যথাসময়ে ভিসার জন্য আবেদনও করা হয়েছিল। তাকে ভিসা দেওয়াও হয়েছিল। তবে ওই ভিসা নিয়ে প্রতিবেশী দেশের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে নির্ধারিত সম্মেলন শেষ হয়ে যাবে। কবির সঙ্গে ভিসা নিয়ে এই আচরণটি করা হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে। কেননা, ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে একটি দৈনিক খবরের কাগজে তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁকের কথা বলতে গিয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন, ভবিষ্যতের মানচিত্র এবং দেশের সীমানা যে আজকের বাস্তবতায় থাকবে– তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? এমনও তো হতে পারে ঢাকাকে রাজধানী করে উপনিবেশ পূর্বে অবিভক্ত বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডল তার পুরোনো রেখা ফিরে পেতেও পারে। আর এতেই আমাদের একজন কবিকে ভিসা পেতে গলদের মুখে পড়তে হয়েছিল।

উপাচার্যের ভিসার আবেদন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। উপাচার্যকে ভিসা না দেওয়া হলে যারা তালি বাজাতে তৎপর তাদের উদ্দেশে একটি কথা বলি। ওনাকে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতে পারেন, নাও করতে পারেন। কিন্তু উপাচার্য পদটি প্রতীকী, একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক। ওনাকে ভিসা না দিয়ে কোনও দেশ বা দূতাবাস যদি ভুলক্রমেও বিব্রতকর নজির স্থাপন করে তা জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার ওপর একটা অসৌজন্য আঁচড়। একই সঙ্গে সেই দেশটির কূটনৈতিক শিষ্টাচারও প্রশ্নের মুখে পড়বে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। 

বিদেশের কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ কেউ কোনও না কোনোভাবে দেশের অসম্মানে তালি বাজাতে চান, তাদের উদ্দেশে একটা গল্প বলে লেখাটির সমাপ্তি টানছি। গ্রামের একটি হাটে পিতা ও পুত্র শত্রুপক্ষের আক্রমণের মুখে পড়েছেন। মাইর যা মোটামুটি পিতার ওপর দিয়েই গেছে। কেননা, তিনিই ছিলেন লক্ষ্যবস্তু। ফিরে এসে পুত্র গদগদ হয়ে বলছে, যা বাঁচা বেঁচে গেছি, আজকে মাইর যা যাবার বাবার ওপর দিয়েই গেছে। গল্প এখানেই শেষ।

লেখক: বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার; বোর্ড সদস্য, সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়ন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ