X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নারীবিদ্বেষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে

মনিরা নাজমী জাহান
০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:২৬আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:২৬

‘নারী বিদ্বেষ’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বহুল প্রচলিত  বহু আকাঙ্ক্ষিত একটি শব্দ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর মধ্যে এক ধরনের বীরত্ব অনুভব করে। এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে প্রতিনিয়ত অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এই সমাজ নারীকে প্রতি এমন সব কারণে বিদ্বেষ ছড়ায় যে সব কারণে হয়তো নারী নিজেই ভিকটিম। নারীকে জীবন্ত বলী দেওয়ার এক মহা উৎসবে মেতে ওঠে এই সমাজ। ঘটনা যেই ঘটাক   সকল বিদ্বেষ নারীর ওপর উগ্রে দেওয়া ভীষণ পছন্দ এই সমাজের।

পুরুষতারিক সমাজ ব্যবস্থা কোনোভাবেই নারীকে মানুষের মর্যাদা দিতে নারাজ। নারী শুধুই তাদের কাছে ভোগ এবং বিষোদাগারের বস্তু। নারী  নির্যাতনের নিত্য-নতুন পথ খোঁজায় ব্যস্ত এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

যে নারীকে নিয়ে এত বিদ্বেষ এত বিষোদাগার, সেই নারীর কি সমাজে কোনও অবদান নেই? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন এবং নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। নারী সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশে নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় ৪ বছর বেশি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২১’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীদের গড় আয়ু ৭৫ বছর, যেখানে পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) তাদের করা গবেষণা ‘রিয়ালাইজিং দ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রমোটিং ফিমেইল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন’-এ বের করেছে, জিডিপিতে নারীর ভূমিকা ২০ শতাংশ। এটি একজন নারী বছরে যত কাজ করেন, তার মাত্র ১৩ থেকে ২২ শতাংশের হিসাব। বাকি ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ কাজের বিনিময়ে কোনও মূল্য পান না তারা। তাই ওই কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটি যুক্ত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান হতো পুরুষের সমান। তবে নারীর ওপর চলা সহিংসতায় যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশের সমান।

বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির আকার প্রায় ২৪ লাখ কোটি টাকা। এর ২০ শতাংশ হিসাব করলে বছরে নারীর আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতে অর্থের বিনিময়ে করা কাজের মূল্য দাঁড়ায় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা—অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। তবে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী কর্মীদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী। তবে শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। যেমন, কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সার্ভে অব ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ’ (এসএমআই) নামের জরিপে উঠে এসেছে দেশে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ছে এবং বিশেষ করে এটি হচ্ছে শিল্প খাতে। এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৪৪ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে তা ২৪ লাখ চার হাজার ৬৭১ জন। এই নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৪.৯২ শতাংশ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ২০২১ সালের এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে কাজ করছেন ৪০ লাখ শ্রমিক। তার ৫৯.১২ শতাংই নারী। জিডিপির হিসাবের অন্যতম একটি খাত হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্য। বিবিএসের করা ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০’ জরিপ বলছে, এই খাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দুই লাখ তিন হাজার ১৮৯। নারী উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট (উই) মতে, তাদের নারী গ্রুপে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান কোনও অংশে কম নয়। আজ আমরা যে উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করি সেই উন্নয়নের  অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে নারী। যে দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা নারী। সেই নারীকে অন্তঃপুরে বন্দি রেখে কীভাবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব?

আবার আলোকপাত করা যাক যে নারী উন্নয়নে এত অবদান রাখছে সেই নারীর প্রতি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কেমন আচরণ করে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দেশে গত জুন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু সদ্যসমাপ্ত জুনেই ২৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এতে বলা হয়, গত ছয় মাসে শারীরিক-মানসিকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫২০ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ২২৩ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২৬ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১ কন্যাশিশুকে। শুধু সদ্যসমাপ্ত জুনে ২৬৫ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং  কন্যাসহ ৫৩ জন। অপরদিকে ৫ কন্যাসহ ১৩ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৮ হাজার ৭৯২ জন নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫০ জন।

এই বীভৎসতার এই চিত্র প্রমাণ করে নারী কতটা নিরাপত্তাহীন এই সমাজে। নারীকে প্রতিটি পদে পদে নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হয়। যাপিত জীবনে এমন কোনও সম্পর্ক পাওয়া যাবে না  যে সম্পর্কের কাছে নারী নিরাপদ। বাংলাদেশের বিশাল ভূখণ্ডে এমন এক ইঞ্চি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদে নিশ্বাস নিতে পারে।

সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন নারীর প্রতি বিদ্বেষ কিংবা নির্যাতনের মাত্রা শুধু গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত সমাজে মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন শহরের উচ্চশিক্ষিত মানুষের অন্দরমহল থেকে শুরু করে গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মানুষের বৈঠকখানা সর্বত্র নারী বিদ্বেষ আস্তানা গেড়ে বসেছে। সমাজে যে যত বড় নারী বিদ্বেষী তার প্রাপ্ত বাহবার পরিমাণও তত বেশি। অফলাইন কিংবা অনলাইন কোথাও নিস্তার নেই নারীর। অনলাইনে নারীর প্রতি কটূক্তি এবং অপব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় এসব কটূক্তি এবং অপব্যবহারের মধ্যে থাকে লিঙ্গবাদী ভাষা, নারীবিদ্বেষ, কুবচন, আপত্তিকর ভাষা, হুমকি, যৌন সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, অপমান, এবং কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি হয়েছে নারীবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

এমনকি ধর্মীয় কিছু মহাফিলেও নারীর পর্দা নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে তার অর্ধেকও হয় না পুরুষের নজর সংযত রাখার বিষয় নিয়ে। পুরো সমাজ যেন ওঁৎ পেতে বসে আছে নারীর দোষ ধরার জন্য।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আচরণে মনে হয় পুরুষ যেন পঙ্কিলতামুক্ত একটি সম্প্রদায় যাদের কোনও দোষ ত্রুটি কিংবা পাপ থাকতে পারে না। অপরদিকে নারীর জন্ম হচ্ছে নারীর আজন্ম পাপ।

সবশেষে বলতে চাই– মনে রাখা প্রয়োজন একজন নারী বা কন্যার প্রতি নির্যাতন কেবলমাত্র সেই নারীর প্রতি অপমান কিংবা নির্যাতনের নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রের অর্জিত মানবিকতা মূল্যবোধের অপমান। তাই নীরবতা ভেঙে নারী প্রতি বিদ্বেষ কিংবা নির্যাতনকারীদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। এই জঘন্য অপরাধ যদি সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনকে কলুষিত করে তাহলে সেই দায়ভার সমগ্র জাতিকে বহন হবে।   

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শাহজাদপুরে ট্রাকের ধাক্কার রিকশাচালক নিহত
শাহজাদপুরে ট্রাকের ধাক্কার রিকশাচালক নিহত
অতিরিক্ত ঘামের কারণ হতে পারে এই ৪ খাবার
অতিরিক্ত ঘামের কারণ হতে পারে এই ৪ খাবার
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জেতা সহজ হবে না: শান্ত
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জেতা সহজ হবে না: শান্ত
আদালতে মিল্টন সমাদ্দার
আদালতে মিল্টন সমাদ্দার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ