X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিবিদদের ভাষা ও ‘পাবলিক যা খায়’

নাজনীন মুন্নী
১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৩৯আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৩৯

বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। তবু এই গ্রেফতারের পেছনে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় অশালীন বক্তব্য দেওয়ার কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করায় এই বক্তব্য রেখেছিলেন এ্যানি। বক্তব্যের একদিন পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে আগের দায়ের করা মামলায়। এই শেষ বা শুরু নয়।

তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। আবার তার একটি ফোনালাপ ফাঁসও হয়। পরে তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারাতে হয়েছিল।

বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে যে বিস্ফোরণ তৈরি হয়েছিলো, ক্ষমা চেয়ে তিনি সেই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমন ঘটনা আরও অনেক। তবু থেমে নেই রাজনীতিবিদদের শিষ্টাচার বর্জিত ভাষার ব্যবহার।

তলে তলে আসলে কী হচ্ছে কেউ জানে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ জানে না বিরোধী শিবিরে কী হচ্ছে, বিএনপি জানে না আওয়ামী লীগ কী করবে আবার দু’দলই জানে না বিদেশি বন্ধুরা কার পক্ষে। এসব গুরুত্বপূর্ণ সংকট ঢাকা পড়ছে রাজনীতিবিদদের চটুল ভাষায়। ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে’ বা ‘মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে’ দেওয়ার মতো কথা দলের একজন শীর্ষ নেতার মুখে কতটা মানানসই কে বলবে? তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে নেতা বলছেন–  ‘পাবলিক এইসব শব্দ খায়’।

পাবলিক মানে আমজনতা। রাজনীতিবিদদের যে ভাষা প্রয়োগ দেখছেন তা তারা কতখানি ‘খাচ্ছেন’ নাকি খেয়ে তাদের ‘বদ হজম’ হচ্ছে তা রাজনীতিবিদদের মন্তব্যের পরে জনগণের সমালোচনা আর ট্রলই বলে দিচ্ছে। তারপরও আমরা শুনছি প্রায় প্রতিদিনই। ‘পাবলিক খায়’ বলে যা বলছেন– সেটা দল বা ব্যক্তিকে পাবলিকের কাছে কতটা সম্মানিত করছে সেটা এখন পাবলিকেরই প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। 

দেশের প্রতিটা মানুষের এখন একটিই আলোচনার বিষয়– সামনে আসলে কী হতে যাচ্ছে?  দুই দল অনড়। মাঝে জাতীয় পার্টি একূল-ওকূল কিংবা দুকূলেই আছে। বসে নেই প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাবেক ভিসি, দফায় দফায় দল বদল করা নেতা। মনগড়া খবর পরিবেশনার পাশাপাশি অনলাইনজুড়ে নিজের মতামত আর বক্তব্য। সেই বক্তব্য প্রয়োগের ক্ষেত্রেও মুখভঙ্গী আর অঙ্গভঙ্গী এমন যে, যে কারও জন্যই তা অসম্মানজনক। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নাম ধরে সম্বোধন করছেন তারেক রহমান। বয়সে যিনি প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের সমকক্ষ। কেবল তাই নয় বিএনপি অনুসারীরাও যে ভাষা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন তাও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য এবং সহনীয় নয়। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয় তাও জনগণের মধ্যে বিতৃষ্ণা তৈরি করছে।

কেবল কি দূর থেকে একে-অন্যকে কথার তীরে বিদ্ধ করা? টকশো উত্তাল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মুখোমুখি বসে সৌজন্যবোধ আর শিষ্টাচারের সীমা ভেঙে একজন আরেকজনকে বেয়াদব বলছেন। ‘তুই তোকারি’ করছেন, টকশো ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছেন, দিচ্ছেন মামলার হুমকি।   

সব কিছু ছাড়িয়ে জাতীয় টেলিভিশনে লাখো দর্শকের সামনে একজন আরেকজনকে মারতে উদ্ধত হচ্ছেন। উত্তেজনা আর রাগের বশে তারা যা করছেন তা কেবল রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা নয়, তারা অগোচরে দেখিয়ে ফেলছেন শিক্ষা ও ভদ্রতার সীমাও। কেবল রাজনীতিবিদরা একে অন্যকে আক্রমণ করেই শেষ করছেন না, উপস্থাপকের সাজ-পোশাক থেকে শুরু করে তাকে সরকার দলের কর্মী উপাধি দিচ্ছেন, কিছু জানেন না বলছেন। এখানেই শেষ নয়, উপস্থাপনা শেখানো চলছে উপস্থাপককেও। টকশো করে যেহেতু স্টার হওয়া যায়, এমনকি এমপি-মন্ত্রীও। কাজেই নিজেকে প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ প্রয়োগ করছেন রাজনীতিবিদরা। আর কিছু ক্ষেত্রে উপস্থাপক আর কর্তৃপক্ষও উসকে দিচ্ছেন তাদের। রাজনীতিতে এই শিষ্টাচার ভঙ্গের ঘটনা মুখের কথায়ই শুধু নয়, অঙ্গভঙ্গিতেও প্রকট।

বক্তৃতা, টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবখানেই কিছু রাজনীতিবিদদের সরব উপস্থিতি। প্রতিপক্ষকে অপমান, অপদস্থ করাই যেন তাদের টার্গেট। আর এটা করতে গিয়ে অপ্রকাশযোগ্য ভাষার ব্যবহারে তারা অনেক এগিয়ে। 

অথচ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কোনও ভাষণে, বক্তব্যে, মন্তব্যে কখনও কোথাও সৌজন্যতাবিবর্জিত ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করতেন না। তার ধারালো বক্তব্যের কোথাও কোনও ব্যক্তি আক্রমণ নেই। তিনি তার চরম প্রতিপক্ষকেও সম্মান করে কথা বলতেন।

শিক্ষাবিদরা বলেন, বাকপটু হওয়ার জন্য একজন নেতাকে তার ভাষার দক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হয়। কুরুচিপূর্ণ এবং নোংরা ভাষা অসভ্য সমাজে চলতে পারে; কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ যখন কুরুচিপূর্ণ ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন সে সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়।

২০১০ সালে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ যিনি তৎকালীন সংসদের স্পিকার ছিলেন, সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, কে কোথা থেকে এসেছেন।’

নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসতে চায় না। তারা রাজনীতিবিদদের অপছন্দ করেন, যে আফসোস দেশে তৈরি হয়েছে তার মূলে আসলে কারা? মন্ত্রমুগ্ধের মতো যার বক্তব্য শুনতে ইচ্ছে করে, শ্রদ্ধায় নত হয় মাথা তাদের সামনে, আমাদের সামনে এমন রাজনীতিবিদ আছেন ক’জনা। 

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
ভাসানটেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় একে একে পরিবারের সবার মৃত্যু
ভাসানটেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় একে একে পরিবারের সবার মৃত্যু
রবিবার দুবাই থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে এমভি আবদুল্লাহ
রবিবার দুবাই থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে এমভি আবদুল্লাহ
একে অপরের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন
একে অপরের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ