X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও এক শতাংশের স্বাক্ষর

খায়ের মাহমুদ
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১০আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:২৬

এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে সারা দেশে ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। বাছাইয়ে তাদের ৪২৩ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। তবে তাদের সবাই প্রার্থিতা ফিরে পেতে আবেদন করেননি।

ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মোট আপিল ছিল ৩২৪টি। এর মধ্যে কয়েকটি আপিল ছিল মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিরুদ্ধে। আর বেশিরভাগ ছিল নিজের প্রার্থিতা ফিরে পেতে। ইসিতে আপিল করে অন্তত ১২৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। বাছাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগ বাদ পড়েছিলেন সমর্থনসূচক সইয়ে গরমিলের কারণে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২(৩ক)(ক) বিধান অনুযায়ী, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন-সংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হয়। তবে কোনও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদের কোনও নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে ওই তালিকা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরতার বিধান? আর যদি বিধান থাকতেই হয় তবে দলীয় প্রার্থী বা ইতোপূর্বে নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেলায় নয় কেন? বিষয়টি আগে এভাবে আলোচিত হয়নি। কারণ, স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যাপারে আগের নির্বাচনগুলোতে তেমন বেশি আলোচনা হতো না, যেটা এবার দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে হচ্ছে।

বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এবং আওয়ামী লীগ দলীয় কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা না দেওয়ায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীর জোয়ার নেমেছে এবার।

সুস্থ অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চর্চায় এটা নতুন সংযোজন বলে আমি মনে করি। কারণ, এটা বড় দল বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে নির্বাচনে আসবে না, এই মনোভাব নিয়ে চলেছে, একই সঙ্গে আন্দোলনের নামে দেশকে করেছে অস্থিতিশীল।

সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটা ভিডিও বার্তা দিয়ে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তিনি দেশের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি অসহযোগিতার কথা বলেছেন, এমনকি কর দেওয়া, অভিযুক্ত অপরাধীদের আদালতে হাজিরা দিতে নিষেধ করেছেন, কীভাবে দেশকে পঙ্গু করে একটা অকার্যকর দেশ তৈরি করা যায় তার রূপরেখা দিয়েছেন। আফসোসের বিষয় হলো, তার এই ১৩ মিনিটের ভিডিওতে একবারও তিনি আগুনে পোড়া মানুষের কথা বলেননি, মায়ের কোলে পুড়ে যাওয়া ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুর কথা বলেননি, রেললাইনে উপড়ে ফেলে মানুষ হত্যার বিচার চাননি। তার বার্তার পুরোটা জুড়ে তার নিজের স্বার্থ এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার আহ্বান ছিল। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে চাইবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু দলটির প্রধান হিসেবে তিনি যে বিবেক বর্জিত ভিডিও বার্তা দিয়েছেন তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

তাই গণতন্ত্রকে সঠিক এবং অধিক অংশগ্রহণমূলক করতে হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করতে তবে সহজতর। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৯টি। দেশের প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাদে অধিকাংশের দলই নামসর্বস্ব, নেই জন সমর্থন, এমনকি নির্দিষ্ট কার্যালয়ও, কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে আইন অনুযায়ী তাদের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের পড়তে হবে না এই এক শতাংশ স্বাক্ষর সংগ্রহের চ্যালেঞ্জে।

তফসিল ঘোষণা থেকে একজন প্রার্থী নমিনেশন জমা দেওয়ার  জন্যে যে সময় পান সেই সময় এই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জোগাড় করা এক বিশাল কষ্টের কাজ, কিছু  কিছু  ক্ষেত্রে অসম্ভবও বটে।  ধরা যাক, একটি নির্বাচনি এলাকাতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৩০ হাজার, একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তার মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ৪ হাজার ৩০০ জন ভোটারের স্বাক্ষর, মুঠোফোনে নম্বর, বর্তমান ঠিকানা ও ভোটার নম্বর জমা দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই অল্প সময়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ করা প্রায় অসম্ভব কাজ। তাই ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহে কেউ কেউ মাঠে কর্মী নামান। কেউ নিজে এবং অনুসারীদের পাঠান ভোটারদের বাড়ি বাড়ি। সুতরাং প্রায়ই যখন স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের কথা শুনি, অধিকাংশ সময় এটা স্বাক্ষর জনিত জটিলতার কারণেই হয়। কারণ, প্রার্থীর প্রদত্ত এই তথ্যগুলো নির্বাচন কমিশন সরেজমিন তদন্ত করতে যায়, একজন সাধারণ ভোটারকে যখন তার স্বাক্ষর এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থনের কথা জিজ্ঞেস করা হয়, স্বাভাবিকভাবেই সে ঘাবড়ে যেতে পারে, এমনকি অস্বীকার করতে পারে, তখনই ঘটে বিপত্তি, কপাল পুড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর। বিষয়টি একজন ভোটারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের চোখে সমতা, আইনের দ্বারা সমান সুরক্ষা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন বা দেবেন না, এটি একান্তই তার চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বিষয়টি স্পষ্ট।

নিশ্চিতভাবেই আরপিও-এর ১২(৩ক)(ক) বিধানের কারণে ভোটারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়াসংক্রান্ত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিকল্প উপায় নির্বাচন কমিশনকে বের করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের মূল্য বৃদ্ধি, কিংবা হলফনামায় অতিরিক্ত শর্ত যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ, স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য স্বাক্ষর দিয়ে অনেক ভোটারই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। স্বাক্ষর যাচাই করতে গেলে ভয়ে ও হুমকির মুখে স্বাক্ষর দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আবার অনেক ভোটার অনৈতিক অর্থ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন।

সুতরাং ভোটারের অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা  রক্ষায় বিধানটি বিলুপ্ত করা যৌক্তিক।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ