X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসার দরকার

দীপংকর গৌতম
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৫৯আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০২

ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। পলাশের ডালে পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে। বেড়েছে চারদিকে ভাষা বিষয়ে বহু আয়োজন। একুশে ফেব্রুয়ারি আসার আগে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা বর্ণমালার ভিন্ন ভিন্ন অক্ষরে শোভিত করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকার দেয়াল। রঙ-তুলিতে মূর্ত হয়ে উঠবে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই দ্রোহগাঁথা রক্তাক্ত ইতিহাস।

সবার ভেতরে একটা প্রশ্ন দেখা দেয় কিনা জানি না, তবে অনেকের ভেতরেই একটা চিন্তা কাজ করে। বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা আবার রাষ্ট্রভাষাও। এই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের পরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আন্দোলনের গতিতে দিশেহারা হয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। আমাদের মায়ের ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এমন আনন্দ, এমন সুযোগ খুব বেশি মানুষের আছে তা নয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালিদের ‘রাজ্য ভাষা’ বাংলা, রাষ্ট্রভাষা কিন্তু নয়। সেখানেও বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বলে মনে হয় না।

মূলত শাসকের ভাষা যেমন একটা বিষয়, একই সঙ্গে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাণিজ্যেও ভাষা একটা বিষয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালিদের শাসকের ভাষা হিন্দি। চাকরি-ব্যবসার ভাষা অনেকটাই ইংরেজি, ফলে বাংলা দুঃখী দুয়োরানির রূপ ধারণ করছে ক্রমশই।

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও কত দূর এগোলো বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালের পর ২০২৪ সালে এসে ভাষার উন্নয়ন কতটা হলো আমরা সে হিসাব কি করেছি?

আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঋদ্ধ বাংলা একাডেমি নামের যে প্রতিষ্ঠানটি ভাষার প্রসার ও সমৃদ্ধি ঘটানোর অঙ্গীকার নিয়ে জন্মেছিল, তার অবস্থা কেমন? একইভাবে ২০১০ সালে দেশের ভেতরে মাতৃভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে আইন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। তাতে ভাষার প্রসার কতটা ঘটেছে আমরা কি জানি? বা জানার মতো কোনও ঘটনা কি এসব প্রতিষ্ঠানে ঘটছে?

ভাষা  মানুষের বাগযন্ত্র থেকে উদ্ভূত উচ্চারিত ধ্বনি সমষ্টি। ভাষা হলো চিন্তাবহ। ভাষা সীমাবদ্ধ ভাব প্রকাশ নয়, অসংখ্য ভাব প্রকাশ করতে পারে। ভাষা বিবর্তনধর্মী, যুগে যুগে তার পরিবর্তন চলে। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে আকার-ইঙ্গিতের নির্বাক অথবা প্রাক-ভাষা থেকে মৌখিক ভাষার জন্ম হয়। তবে ভাষার প্রসার আপনা-আপনি হয় না। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে ভাষার প্রসার। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম বাহক ভাষা। আবার সামাজিক-মানবিক সম্পর্কের জন্য ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বাণিজ্য-অর্থনীতি সব নিয়ন্ত্রণ করে ভাষা। কিন্তু হালে আমাদের ভাষার অবস্থা কেমন হয়েছে সেটা ভাবা দরকার। উচ্চশিক্ষার দিকে তাকালে দেখি কোনও বই বাংলায় নেই। অর্থাৎ অনূদিত হয়নি। ফলে ইংরেজির প্রসার বাড়ছে। ইংলিশ মিডিয়ামে সন্তান পড়ানোর হিড়িক বেড়েছে। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার জায়গায় আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় সন্তানদের আগেই দক্ষ করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়। আর ঘরে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে শিশু কিশোররা শিখছে হিন্দি।

তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলা অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলা ফন্ট নিয়ে বিরাজিত সংকট রয়েই গেছে। শহরের সাইনবোর্ড থেকে হোটেল-ক্লিনিক সবখানে ইংরেজি ভাষার আধিক্য লক্ষ করার মতো। কোথাও খেতে গেলে যে মেন্যু চার্ট ধরিয়ে দেওয়া হয় তা ইংরেজিতে লেখা। দশকের পর দশক চলে গেলেও উচ্চশিক্ষা থেকে হোটেল-রেস্তোঁরা সবখানে ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে। একটা ভাষানীতি চালু হয়নি আজও। একদিকে অর্থনীতি অন্যদিকে বাণিজ্য, সবখানে ইংরেজির আধিক্য। অর্থাৎ বছরের পর বছর পার হলেও ভাষানীতি চালু হয়নি। বিশ্বে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা এখনও টিকে আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে ইংরেজির প্রাধান্য যেটা ঔপনিবেশিক আমলে হয়েছে, সেই উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারছে না মানুষ। মস্তিষ্কে যে উপনিবেশ তৈরি হয়ে আছে দশকের পর দশক ধরে, তা বদলাচ্ছে না। যেভাবে অরক্ষিত ভাষা হয়ে যাচ্ছে বাংলা, তাতে এর কাছে একটা সহজিয়া ভাষাকে ছাড়লে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

চতুর্দশ শতকে ল্যাটিন ভাষার পাশাপাশি কাস্তিলিয় ভাষার ব্যবহার বাড়ালে ল্যাটিন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। ভারতে সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি পালি ভাষা এলে সংস্কৃত মৃত হয়ে আসতে থাকে। আমাদের শিশুরা মারদাঙ্গা সিনেমার ভাষা ব্যবহারে সাবলীল হওয়ায় হিন্দি ব্যবহার করছে। এখান থেকে সাবধান হতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার ২০২২ সালের নভেম্বরের হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রায় দেড়শ’ কোটি মানুষ এখন ইংরেজিতে কথা বলে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীনের মান্দারিন ভাষা, তৃতীয় ভারতের হিন্দি। এ দুটো ভাষার লোকসংখ্যা যথাক্রমে ১১০ কোটি ও ৬০ কোটি ২২ লাখ। চতুর্থ হচ্ছে স্প্যানিশ (৫৪ কোটি ৮৩ লাখ), পঞ্চম ফরাসি (২৭ কোটি ৪১ লাখ) ও ষষ্ঠ আরবি (২৭ কোটি ৪০ লাখ)। আর সপ্তম অবস্থানটি হচ্ছে বাংলাভাষীদের, যাদের সংখ্যা হচ্ছে ২৭ কোটি ২২ লাখ।

কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ক্ষমতার নিরিখে ভাষার সূচকে (পাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনডেক্স র‌্যাঙ্কিং, ২০১৬) বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ভাষার অবস্থান যথাক্রমে ইংরেজি, চীনা, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি, রুশ, জার্মান, জাপানি, পর্তুগিজ ও হিন্দি। শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলা নেই। ভাষার ক্ষমতা নির্ধারণে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে ভাষার সক্ষমতা, জ্ঞান ও গণমাধ্যম থেকে তথ্য আহরণের সক্ষমতা, ভৌগোলিক কূটনীতিতে যুক্ত হওয়ার সামর্থ্য, ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভাষার উপযোগিতা এবং সংলাপের ক্ষমতা। কোনও ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তার অর্থনীতির এই ফারাকটা দূর করতে না পারলে ভাষার প্রসার কীভাবে সম্ভব?

শুধু ব্রিটিশ কাউন্সিল ও বিবিসির প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা, তাদের প্রচার প্রসার ইংরেজিকে ক্রমশ রফতানিযোগ্য ভাষার শীর্ষে নিয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।

একইভাবে শিল্প-সাহিত্যে ইংরেজি ও তাদের অনুবাদেও প্রভাবের বলয় থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, ইংরেজির প্রসার প্রচার এবং বিশ্বের যেকোনও ভাষার সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক সবখানে সবার আগে ইংরেজি প্রকাশনাগুলো পৌঁছায় বা অনলাইনে পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাহলে এই বলয় থেকে কীভাবে বের হওয়া যাবে?

নিজের ভাষাকে পোক্ত করতে হবে, প্রসার ঘটাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় লক্ষ করি যে বেশি ইংরেজি লেখক দার্শনিকদের লেখার উদ্ধৃতি দিতে পারি তাকে তত বিদ্বান ভাবি। আমাদের ভাষাভাষী লেখক, দার্শনিকদের গুরুত্ব খুবই কম। আমাদের মস্তিষ্কে উপনিবেশের ভূত থেকে যাওয়ায় উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার নেই।

গত বিশ বছরে সামাজিক উন্নয়নের চিত্র দেখলে আমরা দেখি, ঢাকা থেকে সবখানে হোটেল, ফাস্টফুডের দোকান, ক্লিনিক আর টাওয়ারের বিকাশ ঘটেছে। সেখানেও ইংরেজি নাম, ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের আধিক্য বিশাল। বাংলার অবস্থান ক্রমশ থিতু হয়ে আসছে। বাংলা ভাষার সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সিনেমা, নাটক ও গানের মাধ্যমে সমৃদ্ধির ধারাকে শক্তিশালী করতে সরকারিভাবে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে না বলেই ভাষা সংকুচিত হচ্ছে। ভাষার ওপর কোনও লেখা নিয়ে পত্রিকায় গেলেও বলে- ফেব্রুয়ারি মাসে আনেন। বাংলা ভাষা ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বাংলা ভাষার বৈশ্বিক প্রসার ঘটাতে হলে জাতিসংঘের কাজের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা দরকার। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা জরুরি। বাংলা ভাষা শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে নয়, সারা বছর পাখির গানের মতো প্রচার ও প্রসার জরুরি।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি অনিক, সম্পাদক জাওহার
ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি অনিক, সম্পাদক জাওহার
মুম্বাইকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে লখনউ
মুম্বাইকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে লখনউ
তপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
আজ মহান মে দিবসতপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ