X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পত্ররাজনীতির অন্দর-বাহির

ড. রাশিদ আসকারী
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৫আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩২

সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী এবং অন্যান্য বিশ্বনেতা মিলে  ২৪২ জনের একটি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। কিছু দিন আগেও এক ডজন মার্কিন সিনেটরের লেখা এরকম একটি চিঠি নিয়ে রাজনীতির আকাশে ঝড় উঠেছিল।  

মার্কিন মুল্লুক থেকে  এ ধরনের পৌনঃপুনিক পত্রবাণের লক্ষ্যবস্তু হলো শেখ হাসিনার সরকার। ইউনূস-পক্ষীয়রা চান শেখ হাসিনাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়াকে শিথিল করতে এবং তাকে আইনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

মার্কিন প্রশাসনের ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনার সরকারের চলন বাঁকা, কারণ তারা তাকে পছন্দ করে না। আর না করারই কথা। শেখ হাসিনা তাদের পরিকল্পনা মতো অন্তহীন অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা সঁপে দিয়ে সরে পড়েননি এবং বিলেত প্রবাসী এক ’যুবরাজের’ গদিতে বসার পথ সুগম করে দেননি। বরং তাদের সমর্থিত দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে একেবারেই আমলে না নিয়ে, তাদের ক্রনিক হরতাল, অবরোধ, অসহযোগকে এতটুকু পাত্তা না দিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি করেই ফেললেন; নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেন; এবং বিশ্ব রাজনীতি মঞ্চের বড় বড় খেলোয়াড়দের স্বীকৃতি-সমর্থন আদায় করে নতুন উদ্যমে বিশ্বের দীর্ঘতম সময়কালীন ‘নারী’ সরকার প্রধান হিসেবে রেকর্ড স্থাপন করলেন। ভূ-রাজনীতির অনিবার্য পালাবদলের এই ক্রান্তিকালে  ইউনূসকে শিখণ্ডী বানিয়ে যারা বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর ছিল, শেখ হাসিনা কেবল তাদের স্বপ্নভঙ্গই করেননি, মুখোশধারী শিখণ্ডীর মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং ভূ-রাজনীতির খল-খেলুড়েদের সঙ্গে ইউনূসের ক্ষমতা-সম্পর্কের নানামাত্রিক রসায়নের হিসাব কষছেন।

তবে ইউনূসের প্রভুরাও এত সহজে ছাড় দেওয়ার পাত্র নয়। তাদের দমন নীতির সব কৌশলই তারা একে একে ব্যবহার করে চলেছেন। তারপরও মৌখিক বিদূষণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক স্যাংশন পর্যন্ত সবকিছুই যখন ৭ জানুয়ারি (২০২৪) অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে, তখন তারা নতুন ফন্দি আঁটছে– কী করে শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলা যায়।

বিশ্বনেতৃবৃন্দের এই চিঠির ব্যাপারে প্রথম প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা একটি চিঠি যুক্তরাষ্ট্রের এক বহুল প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশের দরকার হলো কেন। যার কাছে লেখা তাকে না দিয়ে ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রচারের মহিমা কি চিঠির প্রত্যক্ষ লক্ষ্যের অতিরিক্ত কিছু ইঙ্গিত করে না? না হলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে এটি বিজ্ঞাপন হিসেবে ছাপা হলো কেন?

২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ওয়াশিংটন পোস্টের ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি ৫ কলাম ১৯ ইঞ্চি। ওয়াশিংটন পোস্টের বিজ্ঞাপনের হাল দর প্রতি কলাম ইঞ্চি ৮০৭ ডলার হিসেবে বিশ্বনেতৃবৃন্দের ইউনূস বিষয়ক চিঠি বাবদ মোট ব্যয় ৭৬ হাজার ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৫ লাখ টাকারও বেশি। উল্লেখ্য, এই ব্যয় বিজ্ঞাপন সংস্থাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়বহির্ভূত। আর শুধু এটাই বা কেন।

অতীতেও ড. ইউনূসকে নিয়ে একই ধরনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে একটি লবিস্ট ফার্ম দ্বারা। ২০২৩ সালের ৭ মার্চ, ওয়াশিংটন পোস্টের পৃষ্ঠা ৭-এ ১৮.৫ ইঞ্চি এবং পাঁচ কলামে ৪০ জন বিশ্বনেতা স্বাক্ষরিত একটি অনুরূপ খোলা চিঠি ছাপা হয়েছিল, "নোবেল বিজয়ীর গভীর উদ্বেগ এবং কল্যাণ" প্রকাশ করে। সে সময়ের বিজ্ঞাপনের হার অনুযায়ী, এর মূল্য ছিল ৭৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এভাবে বারবার প্রায় কোটি টাকা খরচ করার দরকার কি—সে প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খায় বৈকি। ওয়াশিংটন পোস্টের মতো ব্যাপক প্রচারিত পত্রিকায় ক্রমাগতভাবে এই দুটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হওয়া মানুষের মধ্যে এই ধারণা  উসকে দেয় যে অধ্যাপক ইউনূস এবং তার লবিস্ট ফার্ম তার খ্যাতি এবং স্বার্থের বিজ্ঞাপন দিতে অভ্যস্ত। প্রশ্ন উঠেছে যে এই  ধরনের অতি ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন কে স্পন্সর করছে? কী কারণে করছে?

চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করার জন্য নিরপেক্ষ আইন বিশেষজ্ঞদের একটি দল প্রেরণের প্রস্তাবনা দিয়ে বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার সুষ্ঠুতা এবং পেশাদারিত্বের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়ার ক্ষমতার ওপর সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে। বিষয়টি অনভিপ্রেত এবং উদ্বেগজনক। কয়েকজন বিশ্বনেতার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এবং তার আইন ব্যবস্থাপনার প্রতি এই অবিশ্বাসের মেঘ এবং বিকল্প সমাধানের পথ অবলম্বনের প্রস্তাব একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল। যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষের অধিকারহানি এবং ফেডারেল বিচার ব্যবস্থার অনেক বিচ্যুতির কথাই আমরা জানি।  আমাদের দেশের আইন প্রণেতারা যদি উপযাচক হয়ে সেসব বিষয়ে নাক গলাতে যান, তাহলে বাইডেন প্রশাসন তাকে কীভাবে নেবে?

বাংলাদেশের শ্রম আদালত কোনও নোবেল বিজয়ীর বিচার করছে না। শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিচার করছে। সে বিচারের মূল ভিত্তি হলো দৃশ্যমান তথ্যপ্রমাণ। এসময়ে এ ধরনের বাইরের প্রভাব আইনগত পদ্ধতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, বা আইনের মহিমা ক্ষুণ্ন করতে পারে।

তাছাড়া বিশ্বনেতাদের এই দল ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনগত প্রক্রিয়ার কার্যকারণ সম্পর্ক কীভাবে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারে? তাই, "নিরপেক্ষ" আইনজ্ঞদের দল প্রেরণের প্রস্তাবটি চিঠির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। যদিও বিশ্বনেতারা দাবি করেন যে তারা কেবল ড. ইউনূসের মামলাগুলো ন্যায্য ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চান, তবু তা বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে সতর্ক থাকার ইঙ্গিত দেয়।  

বিশ্বনেতাদের চিঠিতে ড. ইউনূসের মামলাকে "বিচারের প্রহসন" হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দেয়ালেও একটা তীর ছোড়ার মতো। যদিও দেশি অনুষঙ্গের বিশ্ব পর্যবেক্ষণ অনেক সময় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, তবে সহায়ক সমালোচনা এবং অযাচিত হস্তক্ষেপের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি আইনগত প্রক্রিয়ার ভেতর-বাহির সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারার আগে যদি তার সমালোচনা করা হয়, তাহলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিচার করা হয়। এছাড়াও কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আইনি স্বায়ত্তশাসনের কাঠামোতে বহিরাগত হস্তক্ষেপের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

চিঠির এই ২৪২ স্বাক্ষরকারী আসলে কারা? তারা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের একটি দল। তারা কেবল ইউনূসের পক্ষের গল্প সম্পর্কেই অবগত বলে মনে হয়। তবে ইউনূস মুদ্রার একটা উল্টো পিঠও তো রয়েছে। সে সম্পর্কে তার বিদেশি বন্ধুরা কতটুকু ওয়াকিবহাল? নোবেল বিজয়ীর গল্পের অপর প্রান্ত হয়তো তাদের  চিত্রিত অংশের  মতো অতটা নিষ্কলুষ  নয়। তারা যদি জানতেন যে ইউনূস দেশের শ্রম আইনের ঘোরতর লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন,  খেটে খাওয়া গরিব শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, তাহলে হয়তো তারা তাদের সীমার বাইরে গিয়ে তার পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না।

আপাতদৃষ্টিতে খোলা চিঠিটি একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির বিপদে তার সহযাত্রী-সহমর্মীদের ঐক্যের মিছিল বলে ভ্রম হতে পারে, তবে তা বস্তুতই অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামোয়  বিদেশি হস্তক্ষেপের সীমা সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দেয়। স্বায়ত্তশাসনের আদর্শকে লঙ্ঘন না করেই বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের উদ্বেগ এবং একটি জাতির সার্বভৌম আইনগত প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজতে হবে। আমাদের পরস্পর নির্ভরশীল বিশ্বে এই ধরনের ভারসাম্য আজ অত্যন্ত জরুরি।

সার্বভৌমত্বের বিষয়টি আরও প্রকট হয় ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরই চিঠি আসার ঘটনার কারণে। এটি রকমারি সংকটের ভেতর দিয়ে অগ্রসরমান একটি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলাটে করার পদক্ষেপ বলে মনে হয়। বিশ্বনেতাদের খোলা চিঠি শেখ হাসিনা সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা, নাকি ন্যায়বিচারের জন্য আন্তরিক আহ্বান, তা নিয়ে একটি সূক্ষ্ম বিতর্ক চলছে। তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যত মহৎ উদ্দেশ্যেই লিখিত এবং বহুল প্রচারিত হোক না কেন, ২৪২ জনের এই পত্র, সব সুবিবেচনাতেই, বাংলাদেশের একান্ত  নিজের একটি  বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করার একটি কূটনৈতিক কৌশল।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে উদ্ভূত যেকোনও দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণের কৌশল ।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশ্বনেতাদের হস্তক্ষেপ নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নবায়ন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চিঠির সময়কাল, উদ্দেশ্য এবং নতুন গঠিত সরকারের স্থিতির ওপর তার সম্ভাব্য প্রভাব আমাদের উদ্বিগ্ন করে। বহিরাগত শক্তি রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ গ্রহণ করে দেশের নেতৃত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তাই বিশ্বনেতাদের এই ঐতিহাসিক চিঠির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাতের বিষয়টি সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা  উচিত।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক; সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ