X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কওমি মাদ্রাসায় ক্রমবর্ধমান ছাত্রসংখ্যা ইতিবাচকও হতে পারে

মোস্তফা হোসেইন
১০ মার্চ ২০২৪, ১৭:৪৯আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪, ২০:০৪

শিক্ষার্থী কমছে স্কুলে, বাড়ছে কওমি মাদ্রাসায়। ডিসি সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রীকে ডিসিরা এমন তথ্য জানালেন। তাদের উদ্বেগের বিষয় স্কুলে শিক্ষার্থী কমে যাওয়াটা। কওমি মাদ্রাসায় বাড়ছে এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ কিংবা মন্তব্য ছিল এমন কোনও সংবাদ চোখে পড়েনি। তবে ‘কান টানলে মাথা আসে’ সেই প্রবাদের সূত্রে অন্য প্রসঙ্গও আলোচনায় আসতে পারে।

প্রথমত, স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে কেন? দ্বিতীয়ত মাদ্রাসায় তাও যেখানে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুপস্থিত সেই কওমি মাদ্রাসার প্রতি শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছে কেন? সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে হাজারটা সমালোচনা থাকলেও এটা সত্য, আধুনিক জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষাই বড় ভূমিকা রাখছে। অথচ সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাসমান।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালে মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থী ছিল ৯০ লাখ ১৬ হাজার ৭৭৩ জন। দুই বছর পর ২০২২ সালে এসে এই শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ২৪৫ জন। অর্থাৎ দুই বছরে শিক্ষার্থী কমেছে ৮৬ হাজার ৫২৪ জন। বেনবেইস-এর হিসাব অনুযায়ী, ১৮ হাজার ৮৭৪টি  সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। এই পরিসংখ্যান যে আরও পরিবর্তন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবর্তনটা নেতিবাচক, তাও বোধগম্য।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে গবেষক আবুল বারাকাত দেখিয়েছেন সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৬১২। ১৮ হাজার ৮৭৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে ৩৯ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। সেখানে দেখা যায়, ২০২০ সালে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে হয় ৪৯ দশমিক ৬ এবং ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে কওমি, হাফেজিয়া ও নুরানি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেশি ছিল। ২০২০ সালে মাদ্রাসায় ৫ বছরের শিশুদের ভর্তির হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশ। সেটি ২০২১ সালে বেড়ে হয় সাড়ে ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের মধ্যে ২০২০ সালে মাদ্রাসায় ভর্তির হার ছিল ১১ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।

একটি অনলাইন গণমাধ্যম ২১ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছে- ‘যদি অনিবন্ধনকৃত মাদ্রাসাগুলো এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাহলে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৪ হাজার, মতান্তরে তা প্রায় ৭০ হাজারের বেশি। সেই হিসাবে গত চার দশকে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ গুণ এবং প্রতি বছর বেড়েছে ১৭৫০টি করে।
ড. আবুল বারাকাতের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী (২০০৮), দেশে মোট মাদ্রাসা ছাত্রের সংখ্যা ৯৮ লক্ষ ২৭ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৮২ জন (৪৬%) এবং কওমি মাদ্রাসায় পড়ে ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬০ জন (৫৪%)। কওমি মাদ্রাসার ৮৫ শতাংশই গ্রামে অবস্থিত এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বোর্ডিংয়ে থেকে পড়ে। অর্থাৎ, প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে আধুনিক শিক্ষা ছাড়া কেবল ধর্মভিত্তিক শিক্ষা পাচ্ছে। ফলে পিছিয়ে পড়ছে সর্বক্ষেত্রে।’

ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ সবার জন্য অতি জরুরি। কিন্তু আধুনিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আধুনিক শিক্ষা বাদ দিয়ে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করলে ধর্ম পালনেও পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, ধর্মকর্ম করার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজেকে ধর্মকর্ম পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলা। তার জন্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে রেখে জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে আগে। একজন মানুষ যখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো নিশ্চিত করতে পারবে তখন তার ধর্মকর্ম পালনও ততটাই নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে ইসলামের ব্যত্যয় ঘটার কোনও কারণ নেই। ইসলামের দুটি ফরজের সঙ্গে মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। জাকাত ও হজ শুধু সামর্থ্যবানদের জন্যই ফরজ। একজন মুসলমান হিসেবে সব ফরজ পালনের সুযোগ থাকুক এটা প্রতিটি মুসলমানেরই চাওয়া। সুতরাং আর্থিকভাবে দরিদ্র থাকাটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

কৌশলগত কারণে হয়তো ডিসিরা মাদ্রাসায় ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর বিষয়টি ওইভাবে প্রকাশ করেননি। কারণ মাদ্রাসাগুলোও শিক্ষা সম্প্রসারণে কাজ করছে। তাদের অবস্থানে থেকে তাই এই বিষয়ে প্রকাশ্যে বলা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে সম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেল বলেছেন, কোন কারণে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। তিনিও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভালো হয়েছে কিংবা খারাপ হয়েছে সেই মন্তব্য করেননি।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কওমি মাদ্রাসায় যে হারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, এই ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে কওমি মাদ্রাসামুখী হওয়াটা আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের আরও জানার প্রয়োজন আছে, কোন কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

আমার বিশ্বাস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের অধিকাংশই মনে করেন, পরকালের জন্য তৈরি করানোই এই মাদ্রাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য। অভিভাবকদের বিশ্বাস, পরকালের পুঁজি করাই মানুষের জন্য বৃহৎ কাজ। সেই তুলনায় দুনিয়াদারির শিক্ষা একেবারেই গৌণ। প্রশ্ন হচ্ছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কি ধর্ম পালন সম্ভব নয়? ধর্মীয় শিক্ষায় পণ্ডিত অবশ্যই আমাদের প্রয়োজন আছে। সংখ্যাটা কত? প্রতি পাড়ায় একজন কিংবা দুই জন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত থাকলে তাঁর দ্বারা পুরো পাড়ার মানুষকে হেদায়েতের পথে আনা সম্ভব। অন্যদিকে প্রতিটি পরিবারেই আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজনীয়তা অতি জরুরি।

শিক্ষার্থীর পছন্দের যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন বলে মনে করি। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী কারিকুলাম যুক্ত করা প্রয়োজন। যাতে মাদ্রাসা থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা জীবন ও ধর্ম দুটোই পালনে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি না হন। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখান থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষালাভের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে। তাদের অনেকেই সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি পাচ্ছে, যা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই মাস্টার্স ডিগ্রি বাস্তব জীবনে কোনও সুফলদায়ক হচ্ছে না। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে তাই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

কারিকুলাম আধুনিক করা হলে সেক্ষেত্রে মাদ্রাসা কিংবা স্কুল যেখানে যার ইচ্ছা লেখা পড়লো তখন সমস্যা হবে না। তাই কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনাও প্রয়োজন।

কওমি শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কারের জন্য একসময় মাওলানা আহমদ শফির নেতৃত্বে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। মাওলানা শফি সাহেবের জীবদ্দশায় ওই কমিটি খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। মূল কারণ ছিল কওমি মাদ্রাসাগুলো চায় না তাদের কারিকুলাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামাক। তারা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় না। সরকারি সহযোগিতাও চায় না। যেভাবে দানের ওপর তারা চলে সেভাবেই তারা চলতে চায়। প্রতিটি মাদ্রাসা তাদের নিজ উদ্যোগে দেশ ও বিদেশ থেকে অনুদান গ্রহণ করে, তাদের জবাবদিহির প্রশ্ন থাকে না। যেহেতু বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে আলোচনায় এসেছে তাই আবারও কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা কারিকুলাম আধুনিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি। আর তখনই ছাত্রভর্তির বিষয়টি নিয়ে আজকের মতো ভাবনার সুযোগ থাকবে না।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিউজিল্যান্ডের
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিউজিল্যান্ডের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ