X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

আমাদের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন সারথির ফেরা

খায়ের মাহমুদ 
১৭ মে ২০২৪, ১৩:০৩আপডেট : ১৭ মে ২০২৪, ২০:১২

নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ৪৪ বছর আগে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেদিন ঢাকায় লাখো লোকের সমাবেশ ঘটেছিল। নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও সেদিন নিজ ভূমিতে ফিরতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি তিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেই তিনি প্রিয়জনহারা মাতৃভূমিতে ফিরেছিলেন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে হতাশা ও অচল অবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছিল, তার প্রত্যাবর্তন সেখানে সাধারণের জন্য ছিল নবজাগরণের সূচনা। দিনটি ছিল ১৭ মে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, রবিবার। 

স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। ওইদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িং বিমানে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বিকাল সাড়ে চারটায় এসে পৌঁছান। বাংলার দশ লাখ মানুষ প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের আবেগ, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও মুক্তির স্বপ্ন বিছিয়ে বরণ করলো। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী জিয়া-মুশতাক গং প্রবর্তিত পাকিস্তানি স্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদের’ পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’য় ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। 

৮১ সালের সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু দলের নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন নেতার জীবনপণ চেষ্টায় সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় ৪ নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির সু-কঠিন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালের ১৭ মে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘যেদিন শেখ হাসিনা ফিরে এলেন, সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেছিল তারা শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই যেন ফিরে পেয়েছেন।‘ তিনি আরও লিখেছেন, তার মনে হয়েছিল আবার আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে, যে রক্তের কাছে আমরা ঋণী, যে ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না, সেই রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার কাছে দলীয় পতাকা তুলে দিয়ে ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করতে পারলাম। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের সম্মেলনের সমাপ্তির দিনে সবার সিদ্ধান্ত অনুসারে তোফায়েল আহমেদ দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যার নাম প্রস্তাব করেন এবং তখনই তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।  

গবেষক ও কলামিস্ট সরদার সিরাজুল ইসলামের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়া খালি মাঠে গোল দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিরে আসায় জিয়া গং ভয় পেয়ে গিয়েছিল বড় কোনও আন্দোলনের। কিন্তু শেখ হাসিনাকে আন্দোলনের কোনও সুযোগ না দিয়ে, ৩০ মে ১৯৮১ নিজ সৈনিকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন জিয়াউর রহমান। ক্ষমতা দখল করে আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী তুমুল আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সেই আন্দোলনে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রাণ দেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বেলা ২টায় চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানার সামনে পুলিশ শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তিনি কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু শাহাদাতবরণ করেন আওয়ামী লীগের ৩৫ জন নেতাকর্মী। শুধু গণতন্ত্রের জন্যেই আন্দোলন নয়, শেখ হাসিনাকে আন্দোলন করতে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, ইতিহাস বিকৃতি ও পাকিস্তানিকরণের বিপক্ষেও। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতিতে পাকিস্তানি কায়দায় জিন্নাহ টুপি, আলখেল্লা, আচকানের সংস্কৃতি প্রবর্তিত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করা হয়েছিল, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নাম নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার চালু হয়েছিল। 

যার ফলে পুরো রাজনীতি এবং সংস্কৃতিটাই এক ধরনের বদলে গেলো। বিচার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো, একইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। মানুষের মানবিক মর্যাদা পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরের সব ঘটনাকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের এ পশ্চাৎযাত্রা রোধ করে বাংলাদেশ সঠিক পথে ফেরে ১৯৯৬ সালে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ বছরের সংগ্রামের পর বাংলাদেশ ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধের পথে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। একইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ফিরে পায়। সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগকে করা হয় স্বাধীন। শিক্ষার হার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সব স্তরে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনে মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ বেড়েছে। 

শেখ হাসিনা ২০০১ থেকে ২০০৮ বিএনপি জামাতের দুঃশাসন ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জীবন ঝুঁকির চূড়ান্ত পর্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দিনবদলের ইশতেহার দিয়ে বাংলাদেশকে কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, যন্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক নানা খাতে উন্নয়নের পরিকল্পনা নেন। তার দৃঢ় নেতৃত্বে দিনবদলের সনদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা সময়ের অনেক আগেই অর্জিত হয়। মানুষ তার সেই আস্থা ভালোবাসা ও প্রবল দেশপ্রেমের মূল্য দিয়েছে টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনে।   

শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি আমরা। শেখ হাসিনা জানেন আগামীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে ও বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্বের স্থান পেতে হলে ব্লু ইকোনমির ওপর জোর দিতেই হবে। 

বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতাসীন সরকার প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকালীন নারী প্রধানমন্ত্রীও তিনি। ফলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই তিনি যান না কেন, সেখানেই মনোযোগের কেন্দ্র থাকেন। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ এবং এলডিসি লিডার হিসেবে তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বিশ্বনেতাদের মধ্যে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় বিশ্বনেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। 

শেখ হাসিনা আজ আমাদের বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন। তার রাজনৈতিক দর্শন চর্চা হয় বিশ্বের নামি সব গণমাধ্যমে। জাপানের প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক নিকেইতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সিনিয়র রিপোর্টার তরু তাকাহাসির করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী, লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৫৯তম স্থানে রয়েছে। লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ কেবল ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, লাওস থেকে পিছিয়ে রয়েছে। 

সম্প্রতি বিখ্যাত টাইম সাময়িকীতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কাভার স্টোরি ছাপা হয়েছে। ওই কাভার স্টোরির মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও এর সরকা প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে পশ্চিমা পাঠকদের ধারণা দেওয়া। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাইম সাময়িকীর ওই প্রতিবেদন তাই বেশ গুরুত্ব বহন করে। 

গার্ডিয়ান পত্রিকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল। এমডিজি ও এসডিজি অর্জনে জাতিসংঘ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে ২০১৫ সালে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার, চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ ও দেশজুড়ে অসংখ্য মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে বিদেশিদের প্রভুত্ব থেকে বের হয়ে আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে তিনিই নতুন করে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনার ফিরে আসা শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই নয়, নেতৃত্বশূন্য বাংলাদেশের পূর্ণতার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যম্ভাবী ছিল। তার নেতৃত্বেই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তিনিই আমাদের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন সারথি, তিনি না ফিরলে যা কখনোই সম্ভব হতো না!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে রাতভর ছাত্র-জনতা ও শিবিরের বিক্ষোভ
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে রাতভর ছাত্র-জনতা ও শিবিরের বিক্ষোভ
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
সর্বশেষসর্বাধিক