X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ নয়, চাই বই

মোস্তফা হোসেইন
০৯ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৫৭আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০১৬, ১৫:১৭

মোস্তফা হোসেইন নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সম্পর্ক। যদি বলি বৈশাখী মেলার কথা, সেখানেও দেখবো কৃষিভিত্তিক সমাজের কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কৃষক হাইট্যা (আউশ) ধান, বাজাল (আমন) ধান ও পাট রোপণের কাজটি চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখে শুরু করতো। যাত্রাটা হতো মেলা দিয়ে। সেখানে বর্ষবরণ উপলক্ষ হলেও মূলত কৃষি সামগ্রী আর বীজ ক্রয়-বিক্রয়ের যোগসূত্র ছিল।
প্রয়োজনে কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে, মেলাতেও। সেটা অনিবার্য। কিন্তু এই পরিবর্তন যদি কোনও ক্ষেত্রে ক্ষতিকর অনুসঙ্গ যুক্ত হয় তাহলে সেটা আমরা কেন গ্রহণ করবো। মানুষের রুচি ও প্রয়োজনের পরিবর্তনের কারণে হয়তো অনেক কিছুই যুক্ত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদেরতো বাছাই করার ক্ষমতা আছে। তাই আজকে অন্তত সেই বিবেচনাটি করা দরকার। যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু পহেলা বৈশাখ কিংবা বর্ষবরণ উৎসবে ঢুকে গেছে, আসুন সেগুলো ছাটাই করি, যা আমাদের ঐতিহ্য এবং প্রয়োজনের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ তা গ্রহণ করি এবং তা ব্যাপক প্রচলনে অংশ নিই।
বর্জনের প্রস্তাব দিয়েই শুরু করি। গত তিন দশক ধরে আমাদের পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের রেওয়াজ হয়েছে। কুমারপাড়া থেকে শানকি আসতে শুরু করে সেই সুবাদে, পয়সাওয়ালারা ৪০০ টাকার ইলিশ ৪০০০ টাকায় কিনে গরম ভাতে পানি ঢেলে পান্তাভাত বানিয়ে খাওয়ার রসিকতা করেন এই উৎসবে। এর উপযোগিতা কী? এর সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সম্পর্ক কী? শানকি আমাদের দারিদ্র্যের প্রতীক। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ টিনের থাল কিংবা চিনামাটির প্লেট কেনার সামর্থ রাখত না, যে কারণে তাকে মাটির শানকি ব্যবহার করতে হতো। (এখন শানকিতে ভাত খাওয়ার রেওয়াজ নেই।) কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের সেই দারিদ্র্যকে উপহাস করার জন্য এটি কেন আমদানি করা হয়েছে উৎসবে তা জানি না।
আর পান্তা-ইলিশ? এটাও উপহাসের অংশ। পান্তা আমাদের গ্রামের মানুষ এখনও খায়। তবে সেটা শখে নয়। সেটাও দারিদ্র্যেরই প্রতীক। যাদের ঘরে সকালে রান্না করার ব্যবস্থা থাকে তারা কিন্তু এখনও ক্ষেতে কাজ করতে যাওয়ার আগে গরম ভাত খেয়েই যায়। কিংবা চিড়া-মুড়ি জাতীয় কিছু। শহুরে কিছু মানুষ সেই না চাওয়া জিনিসটিকেই আমদানি করে দিলেন পহেলা বৈশাখের উৎসবের অংশ হিসেবে।
হঠাৎ করে ইলিশের অতিরিক্ত চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সরবরাহ আর চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্য হওয়ার কারণে ইলিশের দাম বেড়ে যায় অকল্পনীয়। যে কারণে অনেকেই চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে ইলিশ সংগ্রহ করতে থাকেন ফ্রিজে। আর জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী মাসকাল আগে থেকে তা মজুদ করতে থাকে কোল্ড স্টোরেজে, কিংবা ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখা হয় তাদেরই সংগ্রহাগারে। প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্রাইসিস ও মরণপথ তৈরির প্রয়োজন আছে কি? তাই অনুরোধ, এবারের পহেলা বৈশাখ থেকেই পান্তা ইলিশ বন্ধ করার প্রতিজ্ঞা করুন। গ্রামে এখনও পান্তা ইলিশের অত্যাচার ওইভাবে শুরু হয়নি। এখনই তা বন্ধ করতে না পারলে কয়েক বছরের মধ্যে পহেলা বৈশাখের ইলিশ সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর অশুভ এবং মারাত্মক প্রতিযোগিতা শুরু হবে ইলিশের বাজারে।

আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এই বৈশাখী উৎসব/মেলার ধরণ পাল্টেছে প্রয়োজন ও পরিবর্তনের কারণে। গ্রাম ও শহরের জীবন ব্যবস্থায় এখনও ফারাক আছে। তাই নতুন করে যুক্ত হতে পারে কিছু উপাদান পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। এখনতো বিশ্বব্যাপী ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস এমন হরেক উৎসব পালন হয়। যেখানে উপহার আদান-প্রদানের মাত্রাও বেড়েছে। আমরা বাংলা নববর্ষে এমন একটি বিষয় হিসেবে বইকে অনায়াসে যুক্ত করতে পারি।

সকল প্রচার মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে নববর্ষে বই উপহার দেওয়ার কর্মসূচি কি হাতে নেওয়া যায় না পহেলা বৈশাখে? যেহেতু প্রকাশকদের বিষয়টি এখানে জড়িত, সরকারি সংস্থা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পাঠক বৃদ্ধির কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারাও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে এই কাজে। প্রকাশক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র যৌথভাবে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বৈশাখী মেলাগুলোতে বই ফেরি করে উপহার বিতরণে সহযোগিতা করতে পারেন। এতে করে বর্ষবরণে নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে। শিক্ষার্থীরাও কমিশন হিসেবে খণ্ডকালীন কিছু রোজগার করতে পারেন। আর সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হতে পারে বিশেষ একটি দিক।

বর্ষ শুরুর দিনে বাঙালি ঐতিহ্যের পোশাক হিসেবে মেয়েরা শাড়ি পড়ে। অবশ্যই সুন্দর এবং দেশাত্মবোধকেই মনে করিয়ে দেয়। খোপায় ফুল পরে বাঙালি তরুণীরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিলে তা অবশ্যই আমাদের গৌরবকে শাণিত করে। এর সঙ্গে ছেলেরা নিত্য ব্যবহার্য লুঙ্গিকে কেন আনতে পারে না। লুঙ্গি পরে অন্তত বর্তমান ও অতীতকে একসূত্রে গাঁথা যায়। আর আমিতো মনে করি, আমাদের যদি জাতীয় পোশাকের প্রশ্ন আসে তাহলে শাড়ি ও লুঙ্গিকেই বাছাই করতে হবে। সুতরাং এর যাত্রাটা হোক না পহেলা বৈশাখের উৎসব থেকে। শাড়িতো বাস্তবায়ন হয়েই গেছে বাকি আছে লুঙ্গি। লুঙ্গির সঙ্গে পাঞ্জাবি, শার্ট  কিংবা ফতুয়া যাই ইচ্ছা পরতে বাধা কি। এতে করে বাড়তি পয়সা খরচ হবে না কারও। যে লুঙ্গি আমাদের সার্বক্ষণিক পোশাক ছিল এবং এখন শুধু বাসায় ব্যবহার হয় তার মূল্যায়নটা গুরুত্বসহ বিবেচিত হবে।

বই কিংবা লুঙ্গি ব্যবহারে বাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারি বই মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সামান্য অংশ মাত্র বিক্রি হয় তখন। পর্যাপ্ত বই থাকে প্রকাশকদের হাতে। লুঙ্গিতো নতুন করে কেনাও লাগবে না। সকালে নাস্তা খেয়ে পরনের কাপড়টিসহ মেলা কিংবা রমনায় চলে এলেই হলো। আর বাড়তি চাহিদা যদি হয়ও তাতেও সমস্যা হবে কি, এর জন্যতো ইলিশের মতো ফরমালিন ব্যবহার করে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াতে হবে না।

যোগ-বিয়োগের সারাংশ হিসেবে বলা যায়- এবারের পহেলা বৈশাখে স্লোগান হিসেবে যুক্ত হতে পারে, ‘নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন’। পোশাকে যুক্ত হতে পারে ছেলেদের লুঙ্গি। পান্তা-ইলিশ কালচারটা বাদ দিয়ে ক্ষতির হাত থেকে অবশ্যই ভূমিকা রাখা যায় সমাজে। সবচেয়ে বড় হচ্ছে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

আগামী নববর্ষ উদযাপনে ঢাকার অবস্থাটা কী হবে? ভাবনার বিষয় নিশ্চয়ই। গত বছরের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমাদের সরকার কাজে লাগাবে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিকাল ৫’টার পর ওই এলাকায় প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে। প্রস্তাব হিসেবে মন্দ না। যেহেতু পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানটি সকাল থেকে শুরু হয়, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিকেলের পর আনুষ্ঠানিকতা না থাকলে তেমন আর কি ক্ষতি হবে। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি আশা করি অধিকতর গুরুত্বসহ বিবেচিত হবে।

গত বছরের সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রতিবাদে এবছর তরুণ সমাজকে বেশি করে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। বাঙালি সংস্কৃতির সকল কর্মকাণ্ডই যুক্ত হোক বেশি করে। অন্তত বৈশাখের সর্বজনীন আচার-আচরণগুলোকে জোরালোভাবে প্রকাশের মাধ্যমই হতে পারে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে বড় রকমের চপেটাঘাত।

পরিশেষে আত্মরক্ষার প্রশ্নে মনে করা যায়, তেজগাঁও এলাকার সাহসী তৃতীয় লিঙ্গের সেই মানুষটিকে যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে জঙ্গি পাকড়াও করেছিলেন। যদি সতর্কতা থাকে এবং তিন লিঙ্গের মানুষগুলো যদি একের প্রতি অন্যের মমত্ববোধ থাকে, তাহলে দুর্বৃত্তরা পার পেয়ে যাবে এমন ভাবনার কারণ নেই। শুভ হোক অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

 লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
আজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাআজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ