X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাইরাল ও দোষারোপের সংস্কৃতি

আফরিন নুসরাত
১১ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:১২আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:২১

আফরিন নুসরাত গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখেছি, রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শিশু মৃত্যুর ঘটনা অনেককে ভাবিয়েছে ও কাঁদিয়েছে। এ রকম মৃত্যু কোনও মায়ের ও পরিবারের জন্য নিঃসন্দেহে কাম্য নয়! চিকিৎসা বিষয়ক প্রশ্ন এলেই মোটা দাগে সবকিছুতেই আমরা ডাক্তারের ত্রুটি খুঁজে পাই এবং চিকিৎসার মতো একটা মহান পেশায় নিয়োজিত ডাক্তারদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে মোটেও পিছপা হই না, যা মানবিকভাবে উচিত নয়!
আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, কোনও চিকিৎসক রোগীকে সচেতনভাবে মেরে ফেলবেন না! একটি ভিডিও ক্লিপ, যেখানে ওই ভদ্রমহিলার জবানিতে হয়রানির কথা উঠে এসেছে, তা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা আদিঅন্ত না জেনে বা না বুঝেই ডাক্তারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে নেমে যাই এবং সমগ্র ডাক্তার পেশাজীবীকেই সামাজিকভাবে হেয় করতে পিছপা হই না!
বাচ্চাটির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আমি আমার নিজের বাচ্চা হওয়ার অভিজ্ঞতার কিছু কথা তুলে ধরতে চাই, যা পাঠক মনের অনেক কৌতূহল দূর করা ছাড়াও অনেক প্রশ্নের জট খুলবে। যা ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আমরা দেখেছি। সিজার বা সিসেকশন শব্দটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি শব্দ। দশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সিজারিয়ান ডেলিভারি করা হয়ে থাকে; বিভিন্ন হাসপাতাল ভেদে এই চার্জ ভিন্ন হয়ে থাকে—সেই তথ্য কম-বেশি আমাদের সবারই জানা। সেই হাসপাতালের গাইনি বিভাগ বেশ সুনাম রয়েছে এবং ডাক্তার রেহনুমা জাহান একজন পরিচিত।  আমার প্রথম বাচ্চাটি তার তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস আমি তার কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছিলাম। সময়-অসময়ে তাকে আমি ফোন দিয়েছি, তার পরামর্শ নিয়েছি। অনেক সময় হাসপাতালের সিরিয়াল যখন পাইনি, তখনও তিনি সহযোগিতা করেছেন সিরিয়াল পেতে এবং ফোনে জরুরি ছোটখাটো ওষুধ যদি খেতে হতো, সেটার টেক্সটও পাঠিয়েছেন সময়মতো।

এখন আসি, আমার বাচ্চা হওয়ার অভিজ্ঞতার কিছু কথা নিয়ে। শেষের তিন মাসে অনেক সময় মায়েদের রক্তে সুগারের আধিক্য দেখা দেয়, যাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিক বলে। সেটা নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে বাচ্চার শরীরেও সংক্রমিত হয় বা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সংক্রমণজনিত কারণে বাচ্চার ক্ষতি তো হয়ই, অনেক সময় তা বাচ্চার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাচ্চা প্রসব হওয়ার কিছুদিন আগে আমাকেও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যদিও তা ছিল বর্ডার লাইনের বেশি। তখন ডা. রেহনুমা বলেছিলেন, খাবার নিয়ন্ত্রণ ও হাঁটাহাঁটি করে এই ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একইসঙ্গে তিনি আমাকে এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রেফারও করেছিলেন।

তবে আমি নিজেই ভয় পাওয়ায় ৩৮ সপ্তাহে ডাক্তারকে কৃত্রিম ব্যথা তুলে ডেলিভারি করার জন্য অনুরোধ করি। উনি আমাকে পরের দিন ভর্তি হয়ে যেতে বলেছিলেন, আমি সব প্রস্তুতি নিয়ে একদিন পরেই ভর্তি হয়েছিলাম।

ভর্তি হওয়ার পরে লেবার রুমে আমাকে স্যালাইন পুশ করা হলে আমার প্রসববেদনা ওঠে। তা প্রথমে সহনীয় পর্যায়ে থাকে এবং কনস্ট্রাকশন হতে থাকে। কনস্ট্রাকশন মূলত বাচ্চা প্রসব করার জন্য মায়ের শরীরকে তৈরি করে। এসময় পেট শক্ত-নরম হতে থাকে ৫ মিনিট পরপর! কনস্ট্রাকশনের সময় ৪ ঘণ্টা পরপর সিটিজি করে বাচ্চার হার্টবিট ঠিক আছে কিনা, সেটা দেখা হয়; এরমধ্যেই  আমার পেট হঠাৎ অনেক শক্ত হয়ে যায়। ডাক্তারকে বললে তিনি স্যালাইনের ডোজ একটু কমিয়ে দেন এবং এর মধ্যেই তারা দু’বার চেক করেন জরায়ুর মুখ কতটুকু উন্মুক্ত হয়েছে, তা দেখার জন্য। ডাক্তারি ভাষায় এই পদ্ধতিকে পিভি (Prevagainal examination) বলা হয়। ডাক্তার তখন পরীক্ষা করে জানালেন, দুই সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়েছে। সাধারণত ৮ থেকে ১০ সে.মি. উন্মুক্ত হলে বাচ্চা প্রসবের জন্য উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হয় এবং শুধু তখনই মাকে পুশ করতে বলা হয়; এর আগে নয়! জরায়ুর মুখ উন্মুক্ত নাহলে কখনোই পুশ করতে বলা হয় না। কারণ তাতে জরায়ু ফেটে যেতে পারে এবং এতে রক্তপাত থামানো যায় না। তাতে অধিক রক্তক্ষরণজনিত কারণে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে।

তারপর এই সময়ের ভেতরেই, সবমিলিয়ে ১০ ঘণ্টা হবে দুই বার সিটিজি করে বাচ্চার হার্টরেট ঠিক আছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখেন তারা। খুব সচেতনভাবে লক্ষ করলে আপনিও বুঝতে পারবেন, সেটা ঠিক আছে কিনা। প্রথম দু’বার হার্টবিট রেট ঠিক থাকলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পেট আরও শক্ত হয়ে যাচ্ছিল এবং তৃতীয়বার সিটিজি করার সময় আমি লক্ষ করলাম, বাচ্চার হার্টরেট কমে যাচ্ছে। তখন লেবার রুম থেকে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্রুত চলে আসেন এবং আমার বাচ্চার বাবার সঙ্গে কথা বলে আমাকে জরুরিভিত্তিতে ওটিতে নিয়ে যান তারা। তখন সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে আমাদের প্রথম সন্তান জোয়ানা এই পৃথিবীর আলোয় আসে। জোয়ানা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছিল।  তার কোনও শারীরিক ত্রুটি ধরা পড়েনি। জোয়ানা ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই একজন শিশু বিশেষজ্ঞ দেখে নিশ্চিত করার পরেই বাইরে নিয়ে এসে পরিবারকে দেখিয়ে নিয়ে যায়। পরে আমি আরও ১২ ঘণ্টা অবজারভেশনে ছিলাম। সারারাত আমি লেবার রুমের অবজারভেশন ইউনিটে ছিলাম। জোয়ানা নার্সদের কাছেই ছিল। শুধু মাঝেমধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিল। ঠিক পরের দিনই আমাদের কেবিনে নিয়ে এসেছিল। এর চার দিন পর রিলিজ দিলে বাসায় চলে আসি। তার ঠিক ৩ দিন পরে আবারও প্রেসার বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি ওষুধ দিয়ে বাসায় ঘুমাতে বলেছিলেন কিন্তু বাসায় ঘুম হবে না বলে আমাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসে সবাই! সেখানে লেবার রুমের একটি রুমে ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে এবং পরের দিন দুপুরে রিলিজ করে দেয় প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ দিয়ে। সেক্ষেত্রে শুধু বেড চার্জ আর মেডিসিনের টাকাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রেখেছিলেন। বাড়তি কোনও টাকা আমাকে দিতে হয়নি।

 এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো আমরা সবসময় ডাক্তারের দোষ খুঁজি, অথচ আমরা তাদের কাছ থেকেই সেবা পেয়ে আসছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আমরা ভুলে যাই, কোনও ডাক্তার সজ্ঞানে বা সচেতনভাবে তার রোগীকে মেরে ফেলবেন না।  আপনারা যদি ভিডিও’র  ভুক্তভোগী ওই মায়ের সঙ্গে আমার কথাগুলো একবার মিলিয়ে দেখেন, তাহলে অনেক কিছুই হয়তো পরিষ্কার হবে!

জাতিগতভাবে আমরা প্রচণ্ড আবেগী একটা জাতি। কারও দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বড় একপেশে চিন্তা করি আমরা! আর ইদানিং এই সমস্ত ভাইরাল কনটেন্টকে কোনও বিবেচনা ছাড়াই শেয়ার করি। এতে যে কারও সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ক্ষতি হতে পারে, তা ভাবি না বা কোনও দায়ভার আমরা নেই না! আমরা শুধু একটা কথাই বলি, ‘ডাক্তার মানেই ডাকাত’। অথচ কিছু টাকার বিনিময়ে আপনি যে সেবা পাচ্ছেন,সেটা বিবেচনা করছেন না। রাতদিন তারা যে সেবা দিয়ে আমাদের সুস্থ করে তুলছেন, তাও ভাবি না! আমাদের যদি দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসি এবং আবেগী না হয়ে বিবেচনা বোধকে জাগ্রত করি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কনটেন্ট শেয়ার না করি, আমাদের সেই শুভ বুদ্ধির উদয় হোক! পরিবার, সমাজ নিয়েই রাষ্ট্র হয়। আমরা সবাই একটা সুস্থ রাষ্ট্র চাই, যেখানে সচেতন মনোভাবাপন্ন হবে!

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ