প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারাই ক্ষমতায় আসবে। আমার এমন কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই যে, যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি ক্ষমতায় আসতে পারি, আলহামদুলিল্লাহ। যদি না পারি কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু দেশে শান্তি বজায় থাকুক। দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়ে তার সরকার পছন্দ করে নিক। সেই পরিবেশটা বজায় থাকুক, আমি সেটাই চাই। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশটা থাকলে দেশটা এগিয়ে যাবে।’ গত ১৯ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই আয়োজিত ব্যবসায়ী সম্মেলনে দেওয়া ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেশ, রাজনীতি ও নির্বাচনভাবনা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
আগামী নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্য যারা নানা ধরনের গুজব ও বানোয়াট গল্প ছড়াচ্ছেন, যারা প্রচার করছেন যে, বর্তমান সরকার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছেন, তাদের একটি উপযুক্ত জবাব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। ‘যেনতেন’ নির্বাচন নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসতে চান। ২০১৪ সালের মতো একটি বিতর্কিত নির্বাচন যে শেখ হাসিনা চান না, সেটা তিনি গত একবছর ধরেই বলছেন। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় যাওয়াই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার দল আওয়ামী লীগ নয়। তাই এবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই নির্বাচন করছে। নির্বাচনে না জিতলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। তাই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জেতার লক্ষ্য নিয়েই সব প্রস্তুতি শুরু করেছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে টানা দুই মেয়াদে। এই সময়কালে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে উন্নয়ন কাজ। রাস্তাঘাট, রেললাইন, ব্রিজ, পদ্মাসেতু–সবই দৃশ্যমান। মানুষের আয় বেড়েছে, অভাব কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। শিশুমৃত্যু-মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি আছে। প্রশ্ন হতে পারে, সরকারের কি কোনও ব্যর্থতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর কোথাও কোনও সরকারের পক্ষে সব মানুষের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। সব নির্বাচনি অঙ্গীকারও পূরণ করা যায় না। দেখার বিষয় হলো সাফল্যের পাল্লা ভারী, না ব্যর্থতার? যারা শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যের পাল্লা ভারী বলে মনে করেন না, তাদের দৃষ্টি ও মতি বিভ্রম আছে।
খাদ্যখাটতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করা কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি কোনোটাকেই যারা উল্লেখযোগ্য মনে করেন না, তারা হিংসাপরায়ণ। তাদের সঙ্গে বিতর্ক অর্থহীন। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমাদের দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা আছে। দুর্নীতির বিস্তাররোধেও সরকার খুব বেশি সাফল্য দাবি করতে পারবে না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণেও আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এসব বিষয়ে অগ্রগতি ও সাফল্যের জন্য যে রাজনৈতিক সমঝোতামূলক পরিবেশ থাকা প্রয়োজন দেশে তা নেই।
আমাদের দেশে যারা সরকারের কাছে বেশি বেশি গণতন্ত্র আশা করেন, তারা বিরোধী দলের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বা মানসিকতা নিয়ে কথা বলেন না। আওয়ামী লীগকে যারা ‘ফ্যাসিস্ট’ বলতে আনন্দবোধ করেন, তারা বিএনপির মধ্যে উদার গণতন্ত্র খুঁজে পান। ১৫ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল করতে চায়, তাদের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারিত হওয়া উচিত কিনা, সে প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের কি সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়াকে যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ বলে মনে করেন, তাদের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন।
বিএনপি রাজনৈতিক নীতি ও কৌশলে আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হয়েছে বারবার। এবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তারা একেকবার একেক দাবি সামনে এনেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি না নিয়ে তারা ‘অলৌকিক’ কিছু একটার অপেক্ষা করেছে। তারা তাদের সুবিধাজনক অবস্থায় নির্বাচন চেয়েছে। তারা তাদের শক্তিকে বড় করে দেখেছে। আওয়ামী লীগকে দুর্বল ভেবেছে। আওয়ামী লীগও যে একটি জনপ্রিয় এবং জনসমর্থন পাওয়া পুরনো রাজনৈতিক দল, এটা বিএনপি অস্বীকার করে এসেছে। আওয়ামী লীগকে দুর্বল ভাবার খেসারত বিএনপিকে দিতে হচ্ছে।
কিছু সংখ্যক মানুষের আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ মনোভাব আছে। আওয়ামী লীগের কিছু মন্ত্রী-এমপি-নেতা-কর্মীর প্রতিও মানুষের ক্ষোভ অসন্তোষ আছে। নানা ক্ষেত্রে তাদের বাড়াবাড়ি মানুষকে হতাশ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা-ভালোবাসায় কোনও ঘাটতি নেই। অন্যদিকে বিএনপিতে এখন চলছে চরম নেতৃত্ব সংকট। খালেদা জিয়া জেলে। তারেক রহমান লন্ডনে। ভোটে জিতলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা বলতে পারছেন না বিএনপি নেতারা। মানুষ কোন কারণে বিএনপিকে ভোট দেবে? দলের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করতে গিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘরছাড়া নেতা-কর্মীদের ঘরে ফেরা নিশ্চিত করতে এবং দলের প্রধান দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন। তার এই আহ্বান কি মানুষকে খুব উদ্বুদ্ধ করবে? দেশের তরুণ ভোটারদের সিংহভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে। অথচ বিএনপির ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তারপর জামায়াতে ইসলামীকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছে।
ইশতেহারে বিএনপি বলেছে, ক্ষমতায় গেলে কারও ওপর কোনও প্রতিশোধ নেবে না। বলেছে, একটি প্রতিহিংসামুক্ত ও সহমর্মী বাংলাদেশ গড়ে তোলাই বিএনপির লক্ষ্য। এগুলো যে নিছক বলার জন্য বলা বা কাগুজে বাক্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির ছোট বড় নেতারা প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতিতে হুমকি-ধামকি দিয়ে চলেছেন। ৩০ ডিসেম্বরের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশ ছাড়া করা হবে, প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারীদেরও দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তারা এমন কথাও প্রচার করছেন যে, আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি করলে দেশে ২০০১ সালের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।
বিএনপি তার অতীত ভুলের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চায়নি বা দুঃখ প্রকাশ করেনি। তারা যে ভুল করেছিল, সেটা তো ঠিক। তাদের ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ভুল ছিল বলেই এবার সরকার কোনও দাবি না মানা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ভুল তারাই স্বীকার করতে চায় না। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গিয়ে আমার বা আমার সহকর্মীদেরও ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। আমি নিজে ও দলের পক্ষ থেকে আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি’।
শেখ হাসিনার এই ঔদার্য ভোটারদের প্রভাবিত করবে বলেই আশা করা যায়। নির্বাচনের মাঠে যাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না, তারা যখন ভোট বিপ্লবের হুমকি দেয়, তখন মনে আশঙ্কা জাগে, তবে কি তারা ভূতের সঙ্গেও নির্বাচনি জোট করেছে?
শেখ হাসিনা মানুষের ওপর আস্থা রেখে তাদের বিবেচনাবোধের ওপর ভোটের বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কথা বলেছেন। বলেছেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। হুঙ্কার দেননি। দেখে নেওয়ার কথা বলেননি। বলেছেন, জনগণ ভোট দিলেই দেশের জন্য কাজ করবেন তিনি। এমন একজন দেশব্রতী, দেশহিতৈষীকে কাজ করার সুযোগ না দিয়ে মানুষ কারও ব্যক্তিগত ‘সম্মান ও মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠার জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: কলামিস্ট